কালীগঞ্জজানা-অজানাটপ লিডদেখা-অদেখাধর্ম ও জীবন

সম্মিলিত কবরস্থান পাল্টে দিলো ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের এক গ্রামের চিত্র

সাবজাল হোসেন, ষ্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহের চোখ-
শিক্ষার হার ছিল খুবই কম। পরষ্পরের হানাহানি, গোষ্টিগত বিরোধ, রাজনৈতিক দ্বন্দ, সামাজিক কলহ এক সময় গ্রামটিতে লেগেই থাকতো। কারও বাড়িতে অনুষ্ঠান হলেও শুধুমাত্র নিজেদের অনুসারীদেরকেই দাওয়াত দেয়া হতো। ছোট্র কোন ঘটানাতেও গ্রামের মানুষ জড়িয়ে পড়তো সংঘর্ষের মত ঘটনায়। পাল্টাপাল্টি মামলা মোকদ্দর্মার শিকারে হতো অর্থ নষ্ট। সেই গ্রামে আজ বইছে শান্তির সুবাতাস। রাজনৈতিক মতাদর্শে ভিন্ন মতের মানুষ থাকলেও একে অন্যের উপর আজ শ্রদ্ধাশীল। গ্রামের উন্নয়নে সব বয়সী মানুষ হয়েছে একাট্টা। ইতোমধ্যে গ্রামবাসীর সকলের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা হয়েছে স্কুলসহ নানা সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

এরমধ্যে গ্রামের যুব সমাজের উদ্যোগে ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর রাতে গ্রামের সব মানুষ স্কুল মাঠে বসে সম্মিলিত কবরাস্থান নির্মানের মিটিং করে। মুলত সেদিন থেকেই গ্রামের মানুষের মধ্যে বেশি একতাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সেদিন থেকেই গ্রামের মানুষ এক কাতারে। পরষ্পরে হয়ে উঠেছে সহনশীল। অপরের মতামতের ওপর শ্রদ্ধাশীলতার মধ্যদিয়ে ২০১৯ সালের ৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে কবরাস্থানের সাইনবোর্ড টানানো হয়। এখন আর গ্রামটিতে কোন হানাহানি নেই। গ্রামবাসির গাঁটের টাকায় স্থাপিত কবরাস্থানের উন্নয়নের স্বপনই সকলের মধ্যে। কখনও কারও সাথে কোন ভুল বোঝাবুঝি হলে নিজেরা বসে সমাধান করছেন। গ্রামটিতে থানা পুলিশ মামলা নেই । যা দেশের যে কোন গ্রামের মধ্যে দৃষ্টান্ত ও অনুকরনীয়। এ গ্রামটি হলো ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার কোলা ইউনিয়নের খড়িকাডাঙ্গা।

গ্রামবাসীসূত্রে জানাগেছে, তাদের গ্রামটি কৃষিনির্ভর হলেও বর্তমানে শিক্ষার হার বেড়েছে। গ্রামের বেশ কিছু কৃতি সন্তান লেখাপড়া শেষ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্মরত আছেন। এখনকার দিনে ভালো ফলাফল করে অনেকে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যায়নরত রয়েছেন। অথচ ২০ বছর আগেও এ গ্রামটির অবস্থা ছিল নাজুক। সে সময়ে গ্রামের মানুষ সামাজিক দ্বন্দে জড়িয়ে বসবাস করতেন। পরষ্পর মামলা মোকদ্দমা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্ত আজকের অবস্থা সম্পূর্ণই উল্টো। এখন গ্রামের যুব সমাজের উদ্যোগে সবকিছু পাল্টে গেছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা আছে কিন্ত সহিংসতার বালাই নেই। হানাহানির গ্রামটিতে সম্মিলিত উদ্যোগে একটি কবরস্থান নির্মানের মাধ্যমে শান্তির, সুবাতাস নিয়ে এসেছে।

গ্রামের যুব সমাজের অন্যতম সদস্য বাচ্চু মিয়া জানান, এক সময়ে সামাজিক আধিপত্য বিস্তারে মেতে থেকে মারামারি, মামলা ফ্যাঁসাদে জড়িয়ে থাকতেন গ্রামবাসী। এমনকি প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা পর্যন্তও বলাবলি হতো না। সে অবস্থা কাটিয়ে উঠতে গ্রামবাসিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।

সংসারের কাজ ফেলে তারা মামলার পিছেই অনেক সময় আদালতে কাটিয়েছেন। কিন্ত এটা বয়স্কোরা মেনে নিলেও শিক্ষিত যুব সমাজ এর বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। যুবকেরা সম্মিলিতভাবে গ্রামের রাস্তাঘাট, মসজিদ -স্কুল, ঈদগাহসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। সর্বশেষ সম্মিলিত কবরাস্থানের বিষয়টি সামনে রেখে তারা একতাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন।

এ জন্য তারা ৩ বছর আগে একদিন রাতে গ্রামবাসী ডেকে আলোচনায় বসেন। সেখানে সামাজিক মাতবর ও নেতারা উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে যুবকেরা সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, হানাহানিতে জড়িয়ে কোন লাভ হয়নি। হবেও না। বিষয়টি সামাজিক নেতৃবৃন্দসহ গ্রামবাসি সাধুবাদ জানান। তখন থেকে গ্রামের মুরব্বীদের দিকনির্দেশনায় যুবকেরা গ্রামের পরিবেশ ঘুরিয়ে ফেলেছেন। এখন আর কোন ভেদাভেদ নেই। গ্রাম উন্নয়নে গ্রামবাসী আজ একট্ট্রা। যা দেশের যে কোন গ্রামের জন্যই অনুকরনীয় ও ব্যতিক্রমী আদর্শ গ্রাম। মাতবরেরা উপদেষ্টা থেকে তাদের পরামর্শে যুবকদের দিয়ে সম্মিলিত কবরাস্থান নির্মানের জন্য একটি উন্নয়ন কমিটি করা হয়েছে। যে কমিটি গ্রাম ও সম্মিলিত কবরাস্থানের জন্য কাজ করে সফল হয়েছেন।

যুব সমাজের নেতৃত্বদানকারী এমরান হোসেন জানান, যে কোন ভালো কাজে মানুষ বিশ্বাসী কেননা সম্মিলিত কবরাস্থানে গ্রামের অনেকে জমি দান করেছেন। আবার অনেকে নগদ টাকা দিয়েছেন। দানে প্রাপ্ত জমি ছাড়াও কবরাস্থানের পাশ থেকে বেশ কিছু জমি কিনেছেন। যে সুবাদে বর্তমান জমির পরিমান ৫১ শতক। ইতোমধ্যে সকলের দেয়া ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার মাটি ভরাট করা হয়েছে। গ্রামবাসীর সম্মিলিত উদ্যোগে স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনার ও ইউপি চেয়ারম্যান আয়ূব হোসেন কবরাস্থানের রাস্তা নির্মানে দু’দফায় ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। এখন প্রয়োজন প্রাচীর নির্মান করা। যেখানে খরচ হবে ৭ থেকে ৮ লক্ষ টাকা। গ্রামবাসীর দাবি এটা এখন জরুরী এবং এটাও একদিন হয়ে যাবে।

মুঠোফোনে ওই গ্রামের কৃতি সন্তান বর্তমান কানাডা প্রবাসী ডঃ আফসার আলী জানান,ছোটবেলায় গ্রামের মানুষের পরষ্পরের হানাহানি মারামারি দেখেছি। তখন গ্রামের ক্ষত ছিল লজ্জাষ্কর। কিন্ত বর্তমানে সকলে মিলেমিশে বসবাসের পাশাপাশি গ্রামের উন্নয়ন করছে যা দুর থেকে শুনেও ভালো লাগছে। দেশে না থাকলেও আমি জন্মভুমির উন্নয়নে সাধ্যমত আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে যাবো।
সাবেক ইউপি সদস্য জালাল হোসেন জানান, গত ১৫ বছরের মধ্যে এ গ্রামে কেউ কারও নামে কোন মামলা করেনি। ছোটখাটো কোন ঘটনা ঘটলে তারা গ্রামে বসেই শান্তিপূর্ণ সমাধান করে থাকেন।

গ্রামের অপর দুই কৃতি সন্তান মুঠোফোনে আলী হোসেন (বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের জিএম) ও লুৎফর রহমান (খুলনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (সমবায়) জানান, চাকরীসূত্রে তারা বাইরে বসবাস করেন। কিন্ত নিজ গ্রামের জন্য নাড়ির টান রয়েছে। বাইরে থাকলেও নিজ গ্রামের উন্নয়নের কথা শুনলে গর্বে বুক ভরে ওঠে। গ্রামটির যুব সমাজ অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যে পরিবর্তন এনেছে তা অবশ্যই অন্যদের জন্য অনুকরনীয়।

সমাজনেতা আব্দুল ওয়াহেদ বিশ্বাস ও শেখ মোহম্মদ হোসেন জানান, গ্রামের যুব সংগঠন অত্যন্ত সৎ,কর্মঠ ও দায়িত্বশীল। আমরা যেটা পারেনি আমাদের সন্তানেরা তা পারছে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আয়ূব হোসেন জানান, খড়িকাডাঙ্গা গ্রামটিতে মাত্র দুটি পরিবার সোনাতন ধর্মাবলম্বী। বাকি সকলে মুসলিম হলেও তাদের সাথে বোঝাপড়াটা ভালো। তবে ছোটবেলায় দেখেছি অন্যরা ছোটখাটো বিষয় নিয়েও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়তে। কিন্ত বর্তমানে সেই গ্রামটির চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর এটা সম্ভব হয়েছে যুব সমাজের জন্য। ফলে তারা ধন্যবাদ পাওয়ারযোগ্য।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button