ধর্ম ও জীবন

হযরত আলী রা. এর খিলাফত ব্যবস্থা, কৃতিত্ব ও সংস্কার

ঝিনাইদহের চোখঃ
আমিরুল মুমিনিন সাইয়েদেনা আলী মুর্তাজার রা. গােটা খিলাফতকালই গৃহযুদ্ধ, গােলযােগ ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে।

কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি যে অসাধারণ সাহসিকতা, ব্যক্তিত্ব এবং নজীরবিহীন দৃঢ় সংকল্প ও দৃঢ়তার সঙ্গে ন্যায় ও সত্যের জন্য সমস্ত কঠোর পরিস্থিতি ও বিপদাপদের মােকাবিলা করেছেন, তা পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে ততদিন ইসলামের ইতিহাসে স্মরণীয় এবং ন্যায় ও সত্যের অনুসারীদের জন্য থাকবে দৃষ্টান্ত হয়ে।

হযরত আলী রা. বলেন, যারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, জুলুম ও বিদ্রোহ করে এবং যারা দীনের আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে তাগিদ দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, হযরত সিদ্দীকে আকবরের শাসনকালেও ইসলামী রাষ্ট্র অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল অবস্থার মধ্যে ছিল। তা সত্ত্বেও দুটি অবস্থার মধ্যে পার্থক্য ছিল। হযরত আবু বকর রা. এর সহযােগী সবাই ছিলেন বড় বড় সাহাবা, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য ও শিক্ষা যাদেরকে দুর্জেয় শক্তি ও অফুরন্ত উদ্দীপনার উৎস বানিয়ে দিয়েছিলাে।

তারা ছিলেন সরলতা, নিষ্ঠা ও ভালবাসার মূর্ত প্রতীক। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ন্যায় ও সত্য থেকে বহুদূরে এবং দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতায় তাদের চেয়ে কম ছিল পতিপক্ষের।

পক্ষান্তরে তৎকালীন ইসলামি দুনিয়ার বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ যেমন: রাসুল সা. স্ত্রী উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রা., হাওয়ারিয়ে রাসূল স. সাইয়েদেনা যুবায়ের রা, আশারায়ে মুবাশশারার অন্যতম রুকন সাইয়েদেনা তালহা আলখায়ের, উম্মুল মু’মিনির হযরত উম্মে হাবিবার রা. তাই আমীর মুয়াবিয়া রা., মিসর বিজেতা হযরত আমর ইবনুল আস রা. প্রমূক হযরত আলী রাএর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তারা প্রত্যেকেই নিজেকে ন্যায় ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত মনে করেছিলেন।

হযরত আলীর রা. সাথে বড় বড় সাহাবী ও সৎ লােকেরা অবশ্যই ছিলেন। কিন্তু ফিতনাফাসাদ সৃষ্টিকারী এবং সাবাঈ জামায়াত তার জন্য বিপদ হয়ে দাড়িয়েছিল।

হযরত আলী রা.এর রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রকৃত কারণ ছিল এই যে, তিনি হযরত আবু বকর রা. ও উমরের রা.এর মত তাকওয়া পরহেজগারী, দীনদারী ও আমানত, ন্যায়বিচার ও ইনসাফের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু সময় তার অনুকূলে ছিল না। অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল। একদিকে আমীর মুয়াবিয়া রা. তাঁর পক্ষের লােকদের জন্য।

বায়তুল মালের অর্থ ইচ্ছেমত খরচ করছিলেন। অপর দিকে হযরত আলী রা. সবার থেকে প্রতিটি কানাকড়িরও হিসেব সুষ্ঠুভাবে গ্রহণ করতেন। তিনি বায়তুলমালের অর্থকে আল্লাহর মাল এবং তাতে সমস্ত মুসলমানের অধিকার আছে বলে মনে করতেন।

এ কারণে তার সমর্থকরাও বিরক্ত হয়ে তাকে ছেড়ে চলে যায়। তাঁর প্রিয়জনরাত পর্যন্ত তাকে পরিত্যাগ করে চলে যেতে থাকে। কিন্তু সত্য সত্যই এবং মিথ্যা মিথ্যাই। হযরত আলী রা যদি এরূপ করতেন তাহলে রাজনৈতিক দিক দিয়ে তিনি অবশ্যই সফল হতেন। কিন্তু খিলাফতের পদে তিনি নিসন্দেহে ব্যর্থ হতেন।

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী রা. রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ফারুকে আযম হযরত উমর রা. এর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাইতেন। তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কোন পরিবর্তন সাধন করেননি। গভর্নরদের তত্ত্বাবধান এবং তাদের কর্মপদ্ধতি যাচাই বাছাইয়ের বিশেষ ব্যবস্থা করতেন।

কোন গভর্নর নিয়োগকালে তাকে ডেকে উপদেশ দিতেন। তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযােগ আসলে অত্যন্ত কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। হযরত আলীর রা. শাহাদাতের সময় তাঁর শাসনাধীন এলকাসমূহে নিমােক্ত গভর্নরগণ নিয়ােজিত ছিলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বসরায়, উবায়দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ইয়ামানে, যিয়াদ ইবনে সুমাইয়া ফারেসে, কাতাম ইবনে আব্বাস মক্কায় ও তায়েফে এবং আবু আইয়ুব আনসারী মদীনায়। গভর্নরদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলাে কা’ব ইবনে মালেককে। প্রজাসাধারণের জন্য হযরত আলী রা. ছিলেন রহমতের নিদর্শন স্বরূপ। দরিদ্র ও মিসকীনদের জন্য বায়তুলমালের দরজা উনাক্ত ছিল।

বায়তুলমালে যে অর্থ আমদানী হতাে তা ন্যায় ও ইনসাফের সাথে অভাবী ও হকদারদের দিয়ে দেয়া হতাে। বায়তুলমালের তত্ত্বাবধান নিলেই পুরােপুরি করতেন। বনাঞ্চলের ওপর ট্যাক্স ধার্য করা হযরত আলী রা. আবিষ্কার। এভাবে আরাে অনেক ক্ষেত্রে বহু সংস্কার সাধন করেছেন তিনি।

শেরে খােদা হযরত আলী রা. নিজে ছিলেন যােদ্ধা বীরপুরুষ। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনীতে তিনি সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তিনি দেশের সিরিয়া সংলগ্ন অঞ্চলে সামরিক ছাউনি স্থাপন করেছিলেন। তিনি ইরানে সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ ও সামরিক প্রয়ােজনে ফোরাত নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ করেন যা তার উল্লেখযােগ্য কৃতিত্বের মধ্যে অন্যতম।

জাতির নৈতিক ও শারয়ী তত্ত্বাবধানের প্রতি হযরত আলীর অসীম মনযােগ ছিল। এক ব্যক্তি বর্ণনা করছে।

আমি দেখলাম হযরত আলী রা. তালি দেয়া লুঙ্গি পরিধান করে চাদর গায়ে জড়িয়ে কেঁড়া হাতে একাকী বাজারের মধ্যে লােকজনকে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং বাজারের তত্ত্বাবধান করছেন।

অপরাধ নির্মূলের জন্য হযরত আলী রা. তাযির হিসেবে অপরাধীদেরকে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলাে। ইরান ও আর্মেনিয়ায় কিছু সংখ্যক নওমুসলিম মুরতাদ হয়ে গিয়েছিলেন। হযরত আলী রা. তাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করেছিলেন। তারা পরে তাওবা করে পুনরায় ইসলামে প্রত্যাবর্তন করে।

আমিরুল মু’মিনীন হযরত আলী খারেজী ও সাবয়ীদের মূলােৎপাটন কৱেন। এটা ছিল ইসলামের বিরাট খেদমত। সমস্ত সাহা কিরাম তার এ কাজকে অত্যন্ত প্রশংসনীয় বলে মনে করেন।

হযরত আলী রা. নিজে দীনি ইলমের অত্যন্ত উঁচুদরের পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক ছিলেন। ফলে মুসলিম উম্মাহ তার থেকে দীনি ইলম এবং শরীয়তের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক বেশী উপকৃত হয়েছে। আরবী ব্যাকরণ পাত্র (ইলমে নহু) আবিষ্কার দ্বারা তিনি মুসলমানদের যারপর নাই কল্যাণ সাধন করেছেন।

অভ্যাস, চরিত্র ও মর্যাদা হযরত আলী মুর্তাজা রা. আপাদমস্তক দীনদার ও আমানতদারীর মূর্ত প্রতীক ও আল্লাহর অত্যন্ত ইবাদাতগুজার বান্দা ছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আল্লাহর দরবারে মাথা নত করেন এবং অপর থেকেই তাকওয়া, পরহেজগার্স, ন্যায় ও সত্যের অনুসরণ এবং সত্যবাদিতাই তার স্বভাব ছিল।

‘মিথ্যা, পার্থিব প্রদর্শনী এবং পৃথিবীর স্বল্পকালীন ভােগবিলাসকে হযরত আলী রা. সব সময় ঘৃণার চোখে দেখেছেন। তিনি গােটা জীবন কৃতার মধ্যে অতিবাহিত করেছেন। খলিফা থাকাকালেও কৃতা ও স্বল্পে তুষ্টির ক্ষেত্রে পিছপা হননি। প্রথম দুই খলিফার মতই মােটা পরিধেয় বস্ত্র পরিধান করতেন তিনি।

তার দরজায় পাহারাদার বা দারােয়ান থাকতাে না।তার জীবনে কোনো ধরণের বাহুল্য ছিল না। খলিফা থাকাকালেও কোন কোন সময় না খেয়ে থাকতে হয়েছে। কিন্তু তিনি ধৈর্য ধারণ কৱেছেন।

আর্থিক দিক দিয়ে তিনি কোন সময়ই সচ্ছল ছিলেন না। কিন্তু তার মন ছিল ধনী। ক্ষুদার্ত থাকতে হলেও তিনি কখনাে কোন প্রার্থীকে বিমুখ করে ফিরিয়ে দেননি। সরলতা ও বিনয় ছিল হযরত আলী (রা)-এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট। নিজের হাতে বাড়ীর কাজ করতেন। মেহনত মজদুরীতে তিনি কোন প্রকার লজ্জা বা অপমান বােধ করতেন না।

একদিন কেউ তার কাছে কোন বিষয়ে জানার জন্য আসলে দেখতে পান তিনি নিজ জুতা সেলাই করছেন। কখনও তাকে দেখা যেত উট চরাতে কিংবা মাটি কাটতে। তাঁর মেজাজে কোন কৃত্রিমতা ছিল না। তাই অনেক সময় শুধু মাটির উপরেই শুয়ে পড়তেন।

এ কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদত্ত ‘আবু তুরাব’ উপাধি তার গৌরবের কারণ হয়। খিলাফতের মসনদে সমাসীন থাকাকালেও তাঁর এই সরলতা বিদ্যমান ছিল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button