জানা-অজানা

হাত ধোয়া জরুরি হলেও অনেকে তা করেন না কেন?

ঝিনাইদহের চোখঃ

আমেরিকার ফক্স নিউজ টেলিভিশনের উপস্থাপক পিট হেগসেট কিছু দিন আগে বলেছিলেন, তার মনে হয় না গত ১০ বছরে তিনি কখনো হাত ধুয়েছেন।

তার এ উক্তি নিয়ে ইন্টারনেটে হৈচৈ পড়ে যায়। অনেকে সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করেন, ‘পিটের হাতে কী কী লেগে আছে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

কিন্তু তার পর খবর বেরোয় যে অভিনেত্রী জেনিফার লরেন্সও ২০১৫ সালে বলেছিলেন, তিনি বাথরুমে যাবার পর প্রায় কখনোই হাত ধুতেন না।

দু’জনেই পরে অবশ্য বলেছিলেন যে তারা শুধু ঠাট্টা করেই এসব কথা বলেছিলেন। অবশ্য এমন লোক অনেকেই আছেন – যারা খোলাখুলিই হাত ধোয়া নিয়ে গোঁড়ামির বিরোধী।

উপস্থাপক পিট হেগসেট গত বছর বলেছিলেন, তার মনে হয় না গত ১০ বছরে তিনি কখনো হাত ধুয়েছেন। পরে অবশ্য তিনি বলেন, কথাটা ঠাট্টা করে বলা।

অনেকেই হয়তো খেয়াল করে থাকবেন যে বাথরুমে যাবার পরও হাত-না-ধোয়া লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়।

এক জরিপে দেখা যায়, ২০১৫ সালে সারা দুনিয়ায় যত লোক বাথরুমে গেছেন এবং যাদের হাতের সাথে ‘মলের সংস্পর্শ’ ঘটে থাকতে পারে – এমন লোকদের মধ্যে মাত্র ২৬ দশমিক ২ শতাংশ বাথরুম ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছেন।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ রবার্ট আউঞ্জার বলেন, এটা কোন জটিল আচরণ নয়, কিন্তু তার পরও মানুষকে হাত ধোয়ার অভ্যাস করানোর অনুপাত খুবই কম।

অনেক দরিদ্র দেশে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুযোগ-সুবিধা আছে মাত্র ২৭ ভাগ মানুষের। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের অনুমান হলো, পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটি লোকের বাড়িতে সাবান এবং পানি কোনটাই নেই।

কিন্তু উচ্চ-আয়ের অনেক দেশে – যেখানে এগুলোর অভাব নেই – সেখানেও বাথরুমে যাবার পর সাবান-পানি ব্যবহার করে মাত্র ৫০ শতাংশ লোক।

জীবনরক্ষাকারী আবিষ্কার

আপনার শুনলে অবাক লাগতে পারে যে মানবজাতির ইতিহাসে যতো বড় বড় জীবনরক্ষাকারী আবিষ্কার হয়েছে – তার মধ্যে অন্যতম হলো হাত-ধোয়া। ১৮৫০ সালে বাপারটা প্রথম জনপ্রিয় হতে শুরু করে এবং তার পর মানুষের প্রত্যাশিত আয়ু অনেক বেড়ে যায়।

এর ফলে অনেক রকম জীবাণু এবং মহামারি থেকে মানুষের বেঁচে যাওয়া সম্ভব হয়।

নিয়মিত হাত ধোয়া কোভিড-১৯ সংক্রমণের সম্ভাবনা কমাতে পারে ২০০৬ সালের এক নিরীক্ষায় বের হয়েছে – নিয়মিত হাত ধোয়ার ফলে আপনার শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ হবার সম্ভাবনাও ৬ থেকে ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

এর পর আসছি কোভিড-১৯ মহামারির প্রসঙ্গে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটা দেশে এই রোগ কী পরিমাণ ছড়াতে পারে তা বোঝা যেতে পারে সে দেশের হাত-ধোয়ার সংস্কৃতি থেকে।

পশ্চিমের কোন কোন দেশে হাত পরিষ্কার করার একটি স্যানিটাইজার কেনার জন্য লোকে ৩৬০ পাউন্ড খরচ করেছে। আবার সাবান ছুঁতেও চায় না এমন লোকও আছে।

একটা রহস্যময় প্রাণঘাতী নতুন ভাইরাসও যদি লোকের স্বভাব বদলাতে না পারে – তাহলে কিসে বদলাবে?

ধারণা করা হয়, এর কারণ শুধুই আলস্য নয়। এর অনেক মানসিক কারণ আছে।

এর সাথে মানুষের নিজস্ব চিন্তাধারা, ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস, ‘স্বাভাবিক’ থাকার চেষ্টা বা তাদের ঘৃণাবোধের মাত্রা – এমন অনেক কিছুই হয়তো সম্পর্কিত। আউঙ্গার বলছেন, সমস্যা হলো, বিশেষ করে উন্নত দেশে অনেক বার হাত না ধুয়েও আপনি ঘুরে বেড়াতে পারেন – কিন্তু আপনার কোন অসুখবিসুখ হবেনা।

তা ছাড়া অনেকের মনে একটা ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস থাকে যে এটা না করলে অন্যদের কোন ক্ষতি হতে পারে – কিন্তু আমার কিছু হবে না।

ধূমপান বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মত আচরণে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এধরণের লোকেরা সম্ভাব্য ঝুঁকির মাত্রা আসলে কতটা – তা আন্দাজ করতে পারেন না।

হয়তো এ মানসিকতা লোককে হাত ধোয়া থেকে বিরত রাখতে পারে।

শিক্ষানবিশ নার্সদের মধ্যে হাত পরিষ্কার রাখা নিয়ে অতি-আত্মবিশ্বাসী প্রবণতা দেখা যায়। যাদের পেশাগত কারণে খাদ্যদ্রব্যে হাত দিতে হয় তারা অনেক সময়ই ভুলে যায় যে তাদের স্পর্শ থেকে অন্য কেউ ‘ফুড পয়জনিংএ’ আক্রান্ত হতে পারেন।

সামাজিক প্রবণতা

বিভিন্ন সংস্কৃতিতে হাত ধোয়ার ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন প্রবণতা দেখা যায়।

একটি ফরাসী জরিপে ৬৩টি দেশের ৬৪ হাজারের বেশি লোককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল – “টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এমন একটা কাজ যা আপনার মজ্জাগত হয়ে গেছে” – এ বক্তব্যের সাথে তারা একমত কিনা।

চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং নেদাল্যান্ডসের অর্ধেকেরও কম মানুষ এর সাথে একমত হয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি – ৯৭ শতাংশ মানুষ – একমত হয়েছিলেন সৌদি আরবে।

জরিপে দেখা যায়, হাত ধোয়ার ব্যাপারে পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা বেশি সিরিয়াস।

যুক্তরাজ্যে কোভিড -১৯ সংক্রমণের পর এক জরিপে দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৫ শতাংশ মহিলা নিয়মিত হাত ধুচ্ছেন। পাবলিক টয়লেটগুলেতে দেখা যায়, আমরা যদি অন্যদের হাত ধুতে দেখি, তাহলে আমরাও হাত ধুই । কিন্তু অন্য কাউকে না দেখলে এটা করার কোন সামাজিক চাপ থাকে না বলছেন আউঙ্গার।

বাস্তবসম্মত বনাম পরীক্ষামূলক চিন্তা

বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটার কারণ বের করতে এ জন্যই আগ্রহী যে এর ওপর অনেক ক্ষেত্রে মানুষ জীবনমৃত্যু নির্ভর করে – বিশেষ করে হাসপাতালগুলোতে।

বছরের পর বছর প্রশিক্ষণ দিলেও অনেক স্বাস্থ্য কর্মীই এই একটি প্রাথমিক করণীয়কে অবহেলা করেন। কিন্তু এর ফলে অনেক মারাত্মক ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ছড়াতে পারে।

জরিপে দেখা গেছে, যাদের মধ্যে শুভবৃদ্ধি জোরালো তারাই বরং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং হাত ধোয়ার ব্যাপারে বেশি যত্নবান। ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় করা এক জরিপে দেখা যায়, সেখানকার এক হাসপাতালের সার্জনরা কোন রোগীর সংস্পর্শে আসার আগে মাত্র ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে হাত ধুয়ে থাকেন। রোগী দেখার পরে হাত ধুয়ে থাকেন ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে।

বহু হাসপাতালেই জরিপ চালিয়ে একই রকম প্রবণতা দেখা গেছে।

কানাডার কুইবেকে এক হাসপাতালে দেখা যায়, সেখানকার স্বাস্থ্য কর্মীরা মাত্র ৩৩ শতাংশ ক্ষেত্রে তাদের হাত ধুয়ে থাকেন।

সৌদি আরবে হাত ধোয়ার জোরালো প্রবণতা থাকলেও দেখা গেছে, সেখানকার মেডিক্যাল কর্মীদের হাতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় না।এক জরিপে দেখা গেছে, যাদের মধ্যে শুভবুদ্ধি জোরালো তারাই বরং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং হাত ধোয়ার ব্যাপারে বেশি যত্নবান।

ঘৃণাবোধ

সবশেষে আছে ঘৃণাবোধ। আপনি যদি দেখেন রান্না করা মাংসের টুকরোর ভেতরে জ্যান্ত পোকা নড়ছে – তখন যে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসার অনুভুতি হয় – সেটাই কিন্তু আমাদের সেই মাংস খাবার ইচ্ছেটাকে নষ্ট করে।

তেমনি আপনি যদি ট্রেনের কামরার অন্য মাথায় আরেকজন যাত্রীর হাতে একটা নোংরা রুমাল বা টিস্যু দেখেন – আপনি হয়তো তার কাছে যেতে চাইবেন না।

এতেও তার জীবাণু শ্বাসের সাথে আপনার শরীরের ভেতরে ঢোকার সম্ভাবনাটা কমে যায়।

শিম্পাঞ্জীদের মধ্যেও দেখা যায়, একে অপরের শরীরের তরল পদার্থের প্রতি বিতৃষ্ণা আছে।

এই বিতৃষ্ণার অনুভুতি যা আমাদের কোন কিছু থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া – এটা রোগ ঠেকানোর ক্ষেত্রে সহায়ক, বলছেন ডিক স্টিভেনসন – অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনোবিজ্ঞানী।

বিজ্ঞানীরা বলেন, এটা একটা শক্তিশালী অনুভূতি যা আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে কাজ করে। সমকামী, বা নারীদের ব্যাপারে অনুভুতি, এমনকি মাকড়সা দেখলে ভয় পাবার ক্ষেত্রেও এটা কাজ করে – প্রভাবিত করে আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও ।

এ অনুভূতির মাত্রা একেজন মানুষের ক্ষেত্রে একেক রকম।

কি করে হাত ধোয়ার অভ্যাস করা যায়?

করোনাভাইরাস সংক্রমণের পটভূমিতে হাত ধোয়া, এর সঠিক নিয়ম ইত্যাদি নিয়ে যে প্রচারাভিযান চলেছে বিশ্বে সম্ভবত আর কখনোই এমন হয় নি।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব প্রচারাভিযানের ফলে যারা হাত ধুতে চায় না – তাদেরকে কি অনুপ্রাণিত করা গিয়েছে? এ নিয়ে ডিক স্টিভেনসন এক জরিপ চালিয়েছিলেন।

অংশগ্রহণকারীদে দু দলকে দুটি ভিডিও দেখানো হয়, একটি ঘৃণা-উদ্রেককারী, অপরটি সাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য।

এর পর তাদের মরা মাছি বা ব্যবহৃত টয়লেট ব্রাশের মত অস্বাস্থ্যকর জিনিস স্পর্শ করতে বলা হয়, তার পর একটি প্লেট থেকে বিস্কুট তুলে নিয়ে খেতে বলা হয়।

গবেষকরা দেখলেন, ঘৃণার উদ্রেক হয় এমন ভিডিও যারা দেখেছেন তাদের হাত ধোয়ার প্রবণতা অনেক বেশি ছিল।

ভালো অভ্যাস

বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একজনকে হাত ধোয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যায়, বলছেন ডিক স্টিভেনসন। তবে, এ উদ্বুদ্ধকরণ চালিয়ে গেলে একটা আচরণ অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তবে সেটা ঘটতে কতদিন লাগে তা আমরা জানিনা।

আউঙ্গার বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে এখন অনেক লোকই হাত ধোয়ার ব্যাপার আগ্রহী হয়েছে. কিন্তু এটা কি এমন পর্যায়ে নেয়া সম্ভব যাতে এটা ধরে রাখা যায়?

এর জবাব এখনো অজানা। তবে করোনাভাইরাস মহামারি কেটে যাবার পর কোন বিখ্যাত লোককে টিভির পর্দায় হাত-না-ধোয়া নিয়ে বড়াই করতে দেখা যাবে – এমন সম্ভাবনা খুবই কম। বিবিসি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button