দেখা-অদেখা

ইতিহাস ঐতিহ্যের লীলাভূমি কুমারখালী

 

ঝিনাইদহের চোখ:
সাগর হোসেন: শত ঐতিহ্য আর গৌরবের এক সোনালী নাম কুষ্টিয়ার কুমারখালী। জগৎ বিখ্যাত মনীষীদের জন্ম আর পদচারনায় ধন্য ও গর্বিত এখানকার মাটি। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে খ্যাত কুষ্টিয়ার প্রাণ কেন্দ্র কুমারখালী একটি শিল্পশহর ।

কুমারখালীর পরিচিতি: ১৮২৮ সালে পাবনা জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলে কুমারখালী পাবনা জেলার অনর্ত্মভুক্ত হয়। এর আগে যশোরের মধ্যে ছিল। ১৮৫৭ সালে কুমারখালীতে মহকুমা প্রতিষ্ঠা হয়। কুমারখালী মহকুমার অধীনে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি, পাংশা, কুমারখালী, খোকসা ও অধুনালুপ্ত ভালুকা থানা অনর্ত্মভূক্ত হয়। ১৪ বছর পর ১৮৭১ সালে কুমারখালী মহকুমা বিলুপ্ত হলে কুমারখালী থানা হিসাবে জন্ম লাভ করে এবং নবগঠিত কুষ্টিয়া মহকুমার অনর্ত্মভুক্ত হয়। এ সময় কুষ্টিয়া মহকুমা নদীয়া জেলার সাথে সম্পৃক্ত ছিল।

১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমারখালী পৌরসভা বর্তমানে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। কুমারখালীর মাটিতে জন্ম গ্রহণ করেছে, খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী, ক্রীড়াবীদসহ অনেক গুণীজন।

সাহিত্যিক সাংবাদিক কাঙালহরিনাথ মজুমদার’র সম্পাদনায় কুমারখালী থেকেই বাংলার প্রাচীন অন্যতম সংবাদপত্র “গ্রাম বার্তা” প্রকাশিত হয়। পদ্মা-গড়াই বিধৌত কুমারখালীর রূপ-রস আর সীমাহিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রাচীন কাল থেকেই বিশ্বখ্যাত পর্যটক, মনীষী আর বিখ্যাত ব্যক্তিরা ছুটে এসেছেন এই জনপদে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক মীর মশাররফ হোসেন, বাউল সম্রাট ফকির লালনশাহ প্রমুখ বিশ্বখ্যাত মনীষীরা আসত্মানা গড়ে তোলেন এই কুমারখালীতে।

শিলাইদহে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী: কুমারখালীর অন্যমত একটি পর্যটন কেন্দ্র হল শিলাইদহে অবস্থিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী। পর্যটন মৌসুম ছাড়াও বছরের বেশীর ভাগ সময় এখানে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পদচারনায় মুখরিত থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন অফিস আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পিকনিক করতে এখানে আসেন। দেশী-বিদেশী পর্যটকের আনাগোনায় বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত কুঠিবাড়ী মুখরিত থাকলেও আজও জাতীয় ভাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃতি মেলেনি। কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ’র স্মৃতি বিজরিত গ্রাম এই শিলাইদহ। কুঠিবাড়ীর উত্তরে পদ্মা আর দক্ষিণে রয়েছে গড়াই নদী। কুঠিবাড়ীর দোতলা থেকে প্রমত্তা পদ্মা সহজেই চোখে পড়ে। কুমারখালী থেকে শিলাইদহের দূরত্ব মাত্র ৫/৬ কিলোমিটার। এই নিভৃত পল্লী গ্রামের সংস্পর্শে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রতিভার বিচিত্র বিকাশ সাধন করেছেন।

১৮৯৯ সালে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই শিলাইদহে আসেন। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সময়ে এই শিলাইদহের পদ্মা পাড়েই সর্ব প্রথম মসত্মবড় নীলকুঠি তৈরী করেন। যখন নীলের ব্যবসা গুটিয়ে সাহেবরা চলে যায় তখন তিন তলার কুঠিরের নীচতলায় জমিদারী খাজনা গ্রহণের কাচারী প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অপর দু’তলা বাসস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। নীলকুঠির প্রমত্তা পদ্মার গর্ভে বিলিন হবে এমন আশংকায় ভেঙ্গে ফেলা হয়। এরপর নতুন করে ১৮৯২ সালে নির্মান করা হয় বর্তমানের স্মৃতিধন্য এই শিলাইদহ কুঠিবাড়ী এবং কুঠিবাড়ী থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দুরে নির্মাণ করা হয় খাজনা আদায়ের জন্য দ্বিতল বিশিষ্ট কাচারী ভবন।

কবিগুরুর কাচারী বাড়ী

জরাজীর্ণ অবস্থায় কাচারী ভবনটি কয়া ইউপির ভূমি অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ভবনের সম্মুখে ছিল পুকুর ঘাট। সেটিও ধবংসাত্ম অবস্থায় শুধুই কালে স্বাক্ষী হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টিতে ৫/৭ বিঘার উপর নির্মিত এই কাচারি ভবনটিও হতে পারে পর্যটকদের দর্শনীয় একটি স্থান।

কবিগুরুর ব্যাবহৃত স্প্রিটবোর্ড:

২২ বিঘা জমিতে প্রায় চার বিঘার উপর প্রাচীর বেষ্ঠিত তিনতলা ভবন এই কুঠিবাড়ী। বাড়ীটির কামরার সংখ্যা ১৮টি। নীচতলায় ৯টি, ২য় তলায় ৭টি ও ৩য় তলায় ২টি কামরাসহ সর্বোমোট ১৮ কামরায় ৮৩টি জানালা, ১৮টি কারুকার্য খচিত দরজা। এসব কামরায় শতাধিক দুর্লভ ছবি ও কবির ব্যবহৃত পালকী, চেয়ার, টেবিল, খাট, সিপ্রটবোর্ড, গদি চেয়ার, নৌকা, সোফাসেট, লেখার টেবিল, আলমারিসহ বিভিন্ন আসবাপপত্র সংরক্ষিত রয়েছে।

কুঠিরের পিছনেও রয়েছে ১টি আকর্ষনীয় লোহার তৈরী পেঁচানো সিঁড়ি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবনের বিরাট অংশের সাথে জড়িয়ে আছে পদ্মা ও গড়াই নদী। এখানেই কবির যৌবনের প্রথম ছোট্ট গল্পের সূত্রপাত ঘটে ছিল। শিলাইদহে বসেই রবীন্দ্রনাথ পল্লীর অনুকূল পরিবেশের রূপ দর্শন করে অনর্গল লিখেছেন। এটা ছিল সাহিত্য সৃষ্টির উর্বর স্থান। সোনার তরী, মানব সুন্দরী, উর্বশী, চিত্রা, ক্ষণিকা, গীতিমাল্যের অনেক কবিতা ও গানসহ নোবেল প্রাপ্ত গীতাঞ্জলী এই শিলাইদহে বসেই তিনি লিখে ছিলেন।

তাছাড়া এই শিলাইদহে গগন হরকরা রচনা করেন “আমার সোনার বাংলা”। আর সে জন্যই কবি লিখেছেন ‘আমার জীবনের যৌবনও পৌড় জীবন সায়াহ্নে সাহিত্য সাধনার তীর্থস’ান ছিল পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহ। কবি এখানে একটানা ১৮৯৯ থেকে ১৯০১ সাল পর্যনত্ম জমিদারী পরিচালনায় থেকেছেন। এছাড়াও সাহিত্য সাধনার কবি জন্য দূর থেকে বার বার ছুটে এসছেন শিলাইদহে। সাহিত্য সাধনার কবি কতবার যে শিলাইদহে এসেছেন তার কোন হিসাব নেই। ঐতিহাসিক কুঠিবাড়ীর পশ্চিমে রয়েছে কবির সাহিত্য সাধনার এক মহতি নিদর্শন ‘বকুল তলার ঘাট’। এই বকুল তালার পুকুর ঘাটে বসেই তিনি রচনা করেছিলেন ‘যে দিন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’।

বর্তমানে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় কুঠিবাড়ী সংরক্ষনের দায়িত্বে রয়েছেন। কুঠিবাড়ীর লাল-খয়েরী রং পরিবর্তন করাই কুঠিবাড়ী তার সুন্দর্য হারিয়েছে এমন অভিযোগ এখানে আসা পর্যটকদের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবনের বিরাট অংশের সাথে জড়িয়ে আছে পদ্মা নদী। তাই পদ্মা নদীর ঢেউয়ের মত করেই কুঠিবাড়ীর চতুর পার্শ্বে প্রাচীর দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের আর্কিষ্ট করতে কুঠিবাড়ীর সম্মুখে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতীর ফুলের বাগান। কুঠিবাড়ীর মধ্যে পর্যটকদের চলাফেরা সুবিধার্থে নির্মান করা হয়েছে পাকা রাসত্মা । এই স্থানে পিকনিক করতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য সরকারী ভাবে কোন সুব্যবস্থা আজও করা হয়নি। পর্যটকদের জন্য থাকার একমাত্র স্থান হল ছোট্ট একটি ডাকবাংলা।

শিলাইদহে থাকার ব্যবস্থা: জেলা পরিষদের ডাক বাংলো ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে উঠা পিকনিক স্পর্ট ও থাকা খাওয়ার সু-ব্যবস্থা রয়েছে। দূরদূরানত্ম থেকে আগত পর্যটক ও পিকনিক পার্টির সুবিধার্তে ২০০২ সালে কুঠিবাড়ীর সম্মুখে দানবীর আলাউদ্দিন আহম্মেদ বেসরকারী ভাবে গড়ে তোলেন আলো ট্যুরিষ্ট কমপ্লেক্সের। এই ট্যুরিষ্টে পর্যটকদের থাকা- খাওয়ার সুব্যবস্থা ছাড়াও তৈরী করা হয়েছে নির্মল পিকনিক স্পট। এখানে থাকার জন্য এসি ও নন এসি কক্ষ রয়েছে। এসি কক্ষে ২৪ ঘন্টার জন্য খরচ দিতে হবে ১ হাজার ও নন এসির জন্য ৫ শত টাকা।

রাণী ভবানী ও প্রিন্স দ্বারকানাথের স্মৃতি বিজড়িত গোপীনাথবাড়ি: শিলাইদহের গোপীনাথবাড়ি ইতিহাস ঐতিহ্যের শেষ স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে এখনো বর্তমান। রাজা-রাজরা আর সামন- প্রভুদের কাহিনী গাথায় ভরপুর গোপীনাথবাড়ি। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের শিলাইদহ ইউপির খোরশেদপুর বাজার সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী এ বাড়িটি ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস। প্রতিদিন যেসব দর্শনার্থীরা রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীতে যান তাদের অধিকাংশই ঘুরেফিরে দেখে আসেন রানী ভবানী, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্মৃতি খ্যাত গোপীনাথবাড়ি। নির্জন, সুনসান বাড়িটির নিরবতার মাঝে পর্যটকরা খুঁজেপান ইতিহাসের গন্ধ। নোনাধরা বাড়ি, পুরোনো দেয়াল, প্রাচীন মন্দির ও বিশাল জলাশয় ধারন করে আছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন স্মৃতি। সবমিলে শিলাইদহের বাড়িটি পরিনত হতে পারে পর্যটকদের তীর্থস্থানে। কুমারখালী উপজেলা সদরের ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পদ্মাপ্রবাহ চুম্বিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি সংলগ্ন গোপীনাথবাড়ির সুবিশাল আঙিনা।

৬ দশমিক ৮৭ একর জমির ওপর রানী ভবানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গোপীনাথ দেবের এই মন্দির ও আশ্রমবাড়ি। স্থাপত্য আর নির্মাণশৈলীর বিবেচনায় সৌন্দযের কোনো ঘাটতি ছিল না সেখানে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নদীয়া রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের আদি নিবাস ছিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বাগোয়ান গ্রামে। শোনাযায় প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে মুঘল সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করার পুরস্কারস্বরূপ ভবানন্দ মজুমদার সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে বিশেষ সম্মান লাভ করেন এবং বাদশাহী ফরমানের বলে নদীয়াসহ চোদ্দটি পরগনার অধিপতি হন। ভবানন্দ বাগোয়ান গ্রামে তার রাজধানী স্থাপন করেন। পরে মাটিয়ারি গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
ভবানন্দের পৌত্র রাঘব রায়ের আমলে মাটিয়ারি থেকে রাজধানী রেউই গ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়। রাঘব রায়ের পুত্র রুদ্র রায় রেউইয়ের নামকরণ করেন কৃষ্ণ নগর। রুদ্র রায়ের প্রপৌত্র কৃষ্ণচন্দ্র রায় ১৭২৮ সালে নদীয়ার রাজা হন। তার আমলকে ‘নদীয়ার স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। এসময় কুষ্টিয়ার কিছু অংশ রানী ভবানীর জমিদারির অন-র্ভুক্ত ছিল। রানী ভবানী কুষ্টিয়া অঞ্চলে বেশকিছু মন্দির প্রতিষ্ঠা ও জলাশয় খনন করেন। শিলাইদহের গোপীনাথ মন্দির এর মধ্যে অন্যতম এবং আদি নিদর্শন। পরবর্তী সময়ে বিক্রমপুরের ভাগ্যকুলের কুন্ডু জমিদার মন্দিরটি ক্রয় করেন। এমনকি উক্ত জমিদার কতৃক গোপীনাথ মন্দিরের বিশেষ পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ হওয়ায় আশপাশে বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
মন্দিরটির স্থাপত্যকলার সৌকর্য সাধনে নলডাঙ্গার মন্দিরও ভুমিকা রাখেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর অন্যান্য জমিদারী ক্রয়ের সুবাদে মন্দিরের মালিকানা লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারী সেরেস্থা হতে গোপীনাথবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সার্বিকভাবে পালন করেন। ঠাকুরবাড়ির জমিদারী বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই গোপীনাথবাড়ির ইতিহাস কিছুটা অনুজ্জল হয়ে পড়ে। দায়িত্ব নেন কালীকৃষ্ণ অধিকারী। এভাবে ইতিহাসের দীর্ঘপথ পরিক্রমার শ্রী শ্রী গোপীনাথ দেবের মন্দিরের শেষ স্মৃতিচিহ্ন একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। তবু এর নকশাঁ ও কারুকর্মখচিত সৃষ্টিশীল স্থাপত্য নির্মাণশৈলী আর ইট গাঁথুনির সৌকর্য সুষমা দেখতে যান অসংখ্য দর্শনার্থী।

বাইরে থেকে যারাই শিলাইদহে রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি দেখতে যান তাদের অধিকাংশই বিনোদন আর ঐতিহ্য উপভোগের মাধ্যম হিসেবে গোপীনাথবাড়ির নির্মাণশৈলী দেখে গন-ব্যে ফেরেন। বনেদী সাক্ষস্বরূপ একটি মূলমন্দির, শিব মন্দির, নাট মন্দির, কৃষ্ণ মন্দির ও স্নান বেদি এবং জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার আলাদা মন্দির রয়েছে। কারুকর্মখচিত আর রকমারি ইটের গাঁথুনিতে গড়া অতিথিশালা ও রন্ধনশালাতো রয়েছেই। দোল পূর্ণিমা, শিব চতুর্দর্শী, জন্মাষ্টমী, বসন্ত উৎসব ছাড়াও ঘটা করে পালন হয় জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা।

এখানকার ঘোল ঢালার মেলা শুধু পুরাতন ঐতিহ্যই নয় সংস্কৃতির বিবেচনায় তা বিশেষভাবে উপভোগ্যও বটে। রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে যেসব পর্যটক ও অতিথি আসেন তারা সবাই কোনোনা কোনোভাবে গোপীনাথবাড়ির ঐতিহ্যের স্বাদ নিয়ে যান। এতোকিছুর পরও সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়সহ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ইতিহাসখ্যাত গোপীনাথবাড়ির ঐতিহ্য রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়নি আজও। এলাকার সন্ত্রাসী ও সামপ্রদায়িক লোকজন ইতিপূর্বে ভেঙে নিয়ে গেছে ইট, সুরকিসহ রড ও পাথর। চুরি যাওয়া মূর্তিরও সঠিক সন্ধান মেলেনি। বিশাল জলাশয় রয়েছে যা তিন বছর মেয়াদি লিজ দেয়া হয়েছে। দেয়াল বেষ্টনী ভেঙে বিক্রি হয়েছে সারবস’। বিগত সময়ে পুরোনো গাছগুলো কাটা হয়েছে ইচ্ছামতো।

টেগোর লজ: বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজরিত আরেকটি নিদর্শন টেগোর লজ কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়ায় অবস্থিত। মূলত এটি ছিল রবীন্দ্রনাথের ব্যবসায়িক দপ্তর। ১৮৯৫ সালে তিনি নিজেকে ব্যবসা-বানিজ্যের সাথে জড়িয়ে ফেলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই ভাগ্নে সুরেন্দ্রনাথ এবং বলেন্দ্রনাথের সহায়তায় শিলাইদহে প্রথম রবীঠাকুর ব্যবসা শুরু করেন কোম্পানীর নাম দেয়া হয় ‘টেগোর এন্ড কোম্পানী’ সে বছরই ব্যবসায়িক সুবিধার্থে টেগোর এন্ড কোম্পানী শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়া শহরে স’ানানত্মরিত করা হয়। এ সময় নিমার্ণ করা হয় টেগোর এন্ড লজ। শরের পূর্বপার্শ্বে মিলপাড়ায় অবসি’ত লাল দ্বিতল ভবনটি কবি প্রেমিদরে আজও আকৃষ্ট করে। পর্যটকরা শিলাইদহে এলে টেগোর লজ পরিদর্শনে উৎসাহী হয়।

এই টেগোর লজে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৫-১৯১১ সাল পর্যনত্ম ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। এ সময় তিনি এখানে বসেই অসংখ্যা ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ রক্ষার্থে অনেক পত্র রচনা করেন। পত্র ছাড়াও বহু কবিতা লিছেছেন এ টেগোর লজে বসেই যা পরবর্তীকালে ‘ক্ষনিকা’ এবং কথাও কাহিনী’ তে প্রকাশিত হয়। বিশ্ব কবির ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান টেগোর লজের ভবনটি আজও পর্যটক ও কবি প্রেমিদের জন্য রাসত্মার পাশে শোভাবর্ধন করে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে ঢাকাস’ বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা সমিতির আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে এই ভবনটি পরিচালিত হচ্ছে জাদুঘর হিসাবে। ব্যবস্থাপনায় রয়েছে কুষ্টিয়া পৌরসভা।

টেগোর লজকে কেন্দ্র করেই সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম এবং মৃত্যুবার্ষীকিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করা হয়। জাদুঘর হিসাবে রূপানত্মরিত হওয়ায় দিন দিন টেগোর লজ আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। শিলাইদহের কুঠিবাড়ীর রং পরিবর্তন করা হলেও টেগোর লজের রং (লাল-খয়েরী) এখনো বিদ্যমান। প্রতিদিন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত টেগোর লজ দর্শনে আসছেন দেশী-বিদেশী পর্যটক।

বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের মাজার: কুমারখালীর আরেকটি দর্শনীয় স্থান হলো কুমারখালীর ছেঁউরিয়া গ্রামে অবসি’ত বাউল সম্রাট লালন শাহের মাজার। প্রতিদিন লালনের মাজার দর্শনে আসেন দুর-দুরানত্ম থেকে পর্যটক ও ভক্তবৃন্দ। সম্রাট লালন শাহের সমাধিস’লের পাশেই রয়েছেন তাঁর নিজ হসেত্ম মুরিদকৃত শিষ্যদের সমাধি।

লালন শাহ বাউল সাধনার প্রধান গুরু, বাউল গানের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা এবং গায়ক। জনশ্রুতি আছে লালন শাহ যৌবনকালে একবার তীর্থভ্রমনে বের হয়ে পথিমধ্যে বসনত্ম রোগে আক্রানত্ম হন। তখন সঙ্গীরা তাঁকে পরিত্যাগ করে যার যার গনত্মব্যে চলে যায়। এমতাবস’ায় সিরাজ সাঁই নামে একজন মুসলমান ফকির তাঁকে মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রষা দ্বারা সুস’ করে তোলেন। এরপর লালন তাঁর নিকট বাউলধর্মে দীক্ষিত হন এবং ছেঁউরিয়াতে একটি আখড়া নির্মান করে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস করেন। তাঁর কোন সনত্মানাদি ছিল না, কিন’ বহু শিষ্য ছিল।
লালন শাহ কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না, কিন’ নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দু-মুসুলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর রচিত গানে সেই জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। আধ্যাত্বিক ভাবনায় তিনি প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেন। তাঁর গান মরমি ব্যঞ্জনা ও শিল্পগুনে সমৃদ্ধ। সহজ-সরল শব্দময় অথচ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর গানে মানব জীবনের আদর্শ, মানবতাবাদ ও অসামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে।

সম্রাট লালন শাহ ছিলেন একজন উদার প্রকৃতির মানুষ। তিনি কোন জাতিভেদ মানতেন না। তাইতো তিনি গেয়েছেন ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন কয় জাতির কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।’ এরূপ সামপ্রদায়িক ভেদবুদ্ধিমুক্ত এক সর্বজনীন ভাবরসে ঋদ্ধ বলে লালনের গান বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সমপ্রদায়ের নিকট সমান জনপ্রিয়। তার রচিত ‘খাচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশী নগড়’, ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’, ইত্যাদি গান বাউল তত্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। লালনের গান এক সময় এতই জনপ্রিয় ছিল যে, তা সাধারন মানুষ ও নৌকার মাঝি মাল্লাদের মুখেই শোনা যেত।

বর্তমানে শিক্ষিত মহলে এ গানের কদর বাড়ছে এবং রেডিও টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচার হচ্ছে। বহু তীর্থভ্রমণ এবং সাধু-সন্নাসীদের সঙ্গলাভের পর ছেঁউরিয়ার আখড়ায় বসেই লালন আজীবন সাধনা ও সঙ্গীতচর্চা করেন। লালনের নিজ হাতে লেখা কোন পান্ডুলিপি পাওয়া যায়নি।

আঞ্চলিক সংবাদ পত্রের জনক, গ্রাম বার্তা পত্রিকার প্রকাশক, কিংবদনিত্ম সংবাদিক, কাঙাল হরিণাথ এবং সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন লালন শাহ ও তার গানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। কাঙাল হরিণাথ তাঁর সাক্ষাত শিষ্য ছিলেন। ছেউড়িয়া থেকে ছয় মাইল দূরে শিলাইদহে অবস্থানকালে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন শাহর ২৯৮টি গান সংগ্রহ করেন এবং সেগুলি থেকে ২০টি গান তিনি প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেন।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়ও লালনের গানের উল্লেখ করেন। গ্রামবার্তায় নিয়মিতভাবে নিষ্পেষিত, নির্যাতিত ও অবহেলিত জনপদ ও সেই অঞ্চলের জমিদার নীল করদের নির্মম অত্যাচার ও শোষণের চিত্র ফুটে উঠতে লাগলো। ১৮৭৩ সালে পাবনা প্রজা বিদ্রোহের প্রজা পক্ষ অবলম্বনে গ্রামবার্তা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সাংবাদিকতার জগতে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের অবদান অবিস্মনীয়।

ধারাবাহিকভাবে পতিত দল অবলম্বন করায় এক সময়ে ঠাকুর জমিদাররাও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন হরিনাথের উপর। দলবল, লাঠিয়াল সহ কাঙাল কুঠিরে আক্রমন করার সংবাদ পেয়ে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ তাঁর বাউল দল নিয়ে তা প্রতিহত করেন। তদুপরি কাঙালের কলম ও তার শক্তি নিসেত্মজ কিংবা সিত্মমিত হয়ে যায়নি। একাধারে পত্রিকায় নামে বেনামে কৌতুক, গদ্য রম্য সহ অনগ্রসর জনসাধারণের মণি হয়ে উঠলেন।

বাউল সম্রাট লালন শাহকে প্রথমে জনসম্মুখে টেনে তুললেন কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তাঁর গ্রামবার্তার মাধ্যমে। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ লা কার্তিক (১৭ অক্টোবর, ১৮৯০) পরলোক গমন করেন। মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর ও (মার্চ-এপ্রিলে) দোল পূর্ণিমা তাঁর ভক্তবৃন্ধ মাজারে সমবেত হন এবং তিনদিন ধরে সাধু সেবা ও সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেনের বাসত্মভিটা: কুমারখালীর দর্শনীয় স্থান হলো কুমারখালীর লাহিনী পাড়া গ্রামে অবস্থিত ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক মীর মশাররফ হোসেনের বাস’ভিটা। প্রতি দিন এখানে আসেন শত শত দেশী-বিদেশী পর্যটক।

১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার লাহিনী পাড়ায় এক সম্ভ্রানত্ম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন জমিদার। নিজগৃহে মুনুশর নিকট আরবি ও ফারসি শেখার মাধ্যমে মশাররফ হোসেনের হাতেখড়ি হয়। পরে পাঠশালায় যেয়ে তিনি বাংলা ভাষা শেখেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় কুষ্টিয়া স্কুলে। পরে তিনি কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল পঞ্চম শ্রেণী পর্যনত্ম অধ্যয়ন করে কলকাতার কালীঘাট স্কুলে ভর্তি হন কিনত্ম তিনি লেখাপড়া আর বেশী দূর অগ্রসর হয়নি।

কর্ম জীবনের শুরুতে মশাররফ হোসেন পিতার জমিদারি দেখাশুনা করেন। পরে তিনি ফরিদপুর নবাব এষ্টেটের ম্যানেজারের চাকরী নেন এবং ১৮৮৫ সালে দেলদুয়ার এষ্টেটের ম্যানেজার হন। এক সময় এ চাকরি ছেড়ে তিনি লাহিনী পাড়ায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পরে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় গিয়ে ১৯০৩-১৯০৯ সাল পর্যনত্ম অবস’ান করেন।

মশাররফ হোসেন ছাত্রাবস্থায় সংবাদ প্রভাকর ও কুমারখালী গ্রামবার্তা প্রকাশিকার মফঃস্বল সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। এখানেই তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু। গ্রামবার্তার সম্পাদক কাঙাল হরিণাথ ছিলেন তাঁর সাহিত্য গুরু। পরবর্তীকালে তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী বিবি কুলসুমও এ ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। মীর মশাররফ ছিলেন বঙ্কিমযুগের অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী ও ঊনিশ শতকের বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ।

বঙ্কিমচন্দ্রের দূর্গেশনন্দীনী প্রকাশের প্রায় চার বছর পর ১৮৬৯ সালে মশাররফের প্রথম উপন্যাস রত্নবর্তী প্রকাশিত হয়। এর পর তিনি একে এক কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, পাঠ্যপুসত্মক ইত্যাদী বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য অন্যন্যা রচনা হল বিষাদ-সিন্ধু, বসনত্মকুমারী, গো-জীবন, উদাসীন পথিকের মনের কথা, নিয়তি ও অবনতী, জমিদার দর্পন নাটকসহ অসংখ্যা গ্রন্থ। তাঁর অমর কীর্তি বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসে কারবালার বিষাদময় ঐতিহাসিক কাহিনী বিবৃত হয়েছে। তাঁর জমিদার দর্পন নাটকটি ১৮৭২-৭৩ সালে সিরাজ গঞ্জে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত হয়।

কুমারখালী শহরে কাঙালকুঠির এবং কুমারখালীর এম.এন. প্রেস: বাংলা সংবাদপত্র প্রসঙ্গে আলোচনা করলে কুমারখালীর নাম ওঠে সর্বাগ্রে। কেননা সংবাদ পত্র প্রকাশের জন্য কুমারখালী ইতিহাসের একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আর এর মূলে রয়েছেন সাহিত্যের সাংবাদিক শ্রী হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙাল হরিনাথ। বাংলাদেশে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার জগতে তিনি অনন্য দৃষ্টান- স্থাপনকারীর দাবিদার। যদিও ইতিহাস তাঁর থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়েছে। দীর্ঘদিন রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে চরম অনাদর আর অবহেলায় পড়ে থাকা কুন্ডুপাড়াস্থ কাঙালহরিণাথের বাস-ভিটায় সরকারী উদ্যেগে কাঙাল স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে।

বাংলার গৌরব, সাংবাদিক ও স্বভাব কবি কাঙালহরিনাথ সম্পর্কে জানা যায় ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই গড়াই তীরবর্তী কুমারখালীতে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। বাল্যকালেই পিতা হলধর মজুমদার এবং মাতা কমলীনী দেবি। পিতা-মাতা হারিয়ে শৈশবেই তাঁকে জীবন সংগ্রামের চিন্তায় বিব্রত থাকতে হয়েছে। কাঙালহরিনাথ পরিনত বয়সে নিঃশ্বাসের নিরক্ষর গ্রামবাসিদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশা দূর করার মানসে এবং তৎকালীন আমলাদের বর্বর-লোমহর্ষক নির্যাতন উৎপীড়ন তৃনমূল থেকে উৎপাটনের হাতে লিখে দ্বি-মাসিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন।

পাশাপাশি কোলকাতার একটি ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিকতার সাথে সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হন। বাংলা ১২৭০ সালে হরিনাথ মজুমদার তাঁর দ্বি-মাসিক পত্রিকা গ্রামবার্তা প্রকাশিকাকে কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে মাসিক হিসেবে প্রথম প্রকাশ করে ইতিহাস গড়েন। প্রত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশের জন্য ব্যাপক আলোড়ন তোলে। পর্যায়ক্রমে তিনি গ্রামবার্তাকে পাক্ষিক ও সাপ্তাহিকে আত্মপ্রকাশ ঘটান। নিয়মিত ১০ বছর ‘গ্রামবার্তা’ কোলকাতা থেকে প্রকাশের পর ১২৮০ সালে স্থাপন করেন একটি প্রেস।

প্রেসটির নামকরন করা হয় মথুরানাথ ছাপা খানা (এম এন প্রেস) প্রেসটি স্থাপনের জন্য সর্বাগ্রে যিনি আর্থিক সহায়তা করেন ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘গ্রামবার্তা’ পত্রিকার মাধ্যমে ইংরেজ শাসন, নীলকরদের নির্যাতন, জোতদার, মহাজন ও পুলিশের অত্যাচার নির্যাতনের বর্ণনা প্রকাশ করা হত। সে সময় হাজারো বাধা ‘গ্রামবার্তা’ কে রুখতে পারেনি, কারন একনিষ্ঠ সাংবাদিক কাঙালহরিনাথ তাঁর লিখনিতে কখনো মাথানত করেনি।

ভয় কিংবা প্রলোভনের কাছে বশ হয়নি তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাইতো পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ থামফ্রে ফাঈম কাঙালহরিনাথকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এডিটর তোমাকে ভয় করি না বটে, কিন’ তোমার লিখনীর জন্য অনেক কুকর্ম পরিত্যাগে বাধ্য হয়েছি’। এই চিঠির কথা গুলোই সাক্ষী দেয় গ্রামবার্তা সে সময় কোন চরিত্রে প্রকাশ পেত।

কাঙালহরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্তা’ প্রকাশের ক্ষেত্রে যে নির্ভিক কলম যোদ্ধার পরিচয় দিয়েছিলেন তা হয়েছিল মূলত সাহসী ও দূঢ় চরিত্রের জন্যই। তিনি ‘গ্রামবার্তা’ এম এন প্রেসকে কেন্দ্র করে কুমারখালীতে একটি সাহিত্য পরিমন্ডল গড়ে তোলেন। যা পরবর্তীতে অবিভক্ত বাংলায় এক বিরাট অবদান রাখে। গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় তৎকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতনামা পন্ডিতরা লিখতেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন বিষয়ক প্রবন্ধ, ছড়া ইত্যাদিও এতে প্রকাশিত হত। প্রখ্যাত মুসলিম লেখক মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়িও হয় এ পত্রিকার মাধ্যমে। তিনি গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার একজন মফঃস্বল সাংবাদিক ছিলেন।

ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় এ পত্রিকায় তার অনেক লেখা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি পরবর্তীকালে মুসলমান রচিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সমন্বয়ধর্মী প্রবর্তক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কাঙালহরিণাথ ছিলেন তাঁর সাহিত্যগুরু।‘বিষাধ সিন্ধু’র কালজয়ী ঔপন্যাসিক মীর মোশাররফ হোসেন ছিলেন কাঙালহরিনাথের অন্যতম শিষ্য। মীরের সম্পাদিত ‘আজিজন নেহার’ ও ‘হিতকারী’ পত্রিকা দু’টির অধিকাংশ সংখ্যাই এম এন প্রেস থেকে প্রকাশিত হত। এ ছাড়াও রাজবাড়ীর রওশন আলীর ‘কোহিনুর’ লোলিত মোহন পাল ও রাধা বিনোদ শাহার ‘শাহাজীর’ পত্রিকাও হরিনাথ মজুমদারের ঐতিহসিক এম এন প্রেস থেকে ছাপা হত।

জানা যায়, বিষাদ সিন্ধু’র প্রখম কপি এ প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয়। হিমালয় ভ্রমনকাহিনীখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক জলধর সেনের সাহিত্যচর্চাও শুরু হয় এ পত্রিকার মাধ্যমে। দিনলিপি ডাইরিতে কাঙালহরিনাথ লিখেছেন আমিই লেথক, আমিই সম্পাদক, আমিই ছাপাকারী, আমিই বিক্রেতা এবং আমিই পত্রিকার প্রধান কর্তা। এই প্রেসের মাধ্যমে তিনি ১০/১২ জনের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।

তাছাড়াও পাঠ্য-পুস-ক, দেশী, বিদেশী পত্র-পত্রিকা বিক্রয় করার জন্য একটি পুস-কালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও সেটি বেশিদিন স্থায়িত্ব পায়নি। কাঙালহরিনাথ মজুমদার প্রায় অর্ধশত পুস-ক রচনা করেন। এর মধ্যে ২১ খানা প্রকাশ পায়। বাংলা সাহিত্যার স্বার্থক উপন্যাস (প্রথম বিজয় বসন- তার উল্লেখ যোগ্য গ্রন্থ। এ ছাড়া কাব্য গ্রন্থ কোমুদী (১৮৬৬), দ্বদস শিশুর বিবরন (১৮৬৯), পদ্য পুশুরী (১৮৬২) কাঙালহরিনাথকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
কাঙালহরিনাথ মথুরানাথ যন্ত্র এবং এম এন প্রেস স্থাপন করলেও পত্রিকা প্রকাশে কখনও স্বচ্ছলতা আসেনি, তিনি লিখেছেন গ্রাম বার্তার রজত জয়ন্তীর প্রাককালে ৭ টাকা ঋনের দায়ে পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার বংশধররা এম এন প্রেসটি আকঁড়ে ধরে আছে আজও।

চলতি পর্যটন মৌসুমে আপনিও ঘুরতে যেতে পারেন ইতিহাস ঐতিহ্যের লিলাভূমি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। স্বল্প খরচে ১দিনে আপনি কুমারখালীর পাঁচটি দর্শনীয় স্থান ঘুরতে পারবেন। যে কোন ভাবে কুষ্টিয়া শহরে আসুন। যদি মনে করেন কুষ্টিয়া শহরে রাত্রি যাপন করবেন তাহলে একাধিক আবাসিক হোটেল রয়েছে। কুষ্টিয়া শহর থেকে ৪ শত টাকায় একটি অটো ভাঁড়া করুন এবং পাঁচটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসুন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button