কোটচাঁদপুরটপ লিড

জমি বিক্রি করে ভারতে টাকা পাচার করছে ঝিনাইদহের হুন্ডি কাজল

#কাজী মৃদুল, ঝিনাইদহের চোখঃ

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বহুল আলোচিত হুন্ডি কাজল ১৪ বছরের সাজায় দীর্ঘদিন ফেরার হয়েও অবৈধ উপায়ে নিজ নামীয় জমি রেজিস্ট্রির মাধ্যমে বিক্রি করে বিক্রিত অর্থ ভারতে পাচার করছেন বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে তিনি ভারতে আলিশান বাড়ি তৈরি করে বসবাস এবং সেখানে ব্যবসা করছেন।

কোটচাঁদপুর পৌর শহরের সলেমানপুর গ্রামের শওকত আলীর (পঁচা মিয়া) ছেলে ফারুক আহমেদ ওরফে হুন্ডি কাজল ও তার ‌আর্শিবাদপুষ্ট এজেন্টরা ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা কোটচাঁদপুরসহ দক্ষিণ পঞ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নে‌ওয়ার ঘটনায় অন্তত ৮টি মামলায় ১৪ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন হুন্ডি কাজল।

এসব অর্থে তার পরিবারের সদস্যদের নামে কেনা সম্পদ ইতিমধ্যেই বিক্রি করে অর্ধশত কোটি টাকা ভারতে পাচার করেছেন। কিছুদিন ঘাপটি মেরে থেকে চুপিসারে গত ১৭/০১/১৯ তারিখে দুটি দলিলের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে সাত বিঘা নিজ নামীয় জমি বিক্রি করে দেন। তার বলাবাড়িয়া ইটভাটার এ জমি ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করলেও দলিলে দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ১৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

যার দলিল নং-১৫৯, গ্রহিতা হচ্ছেন- পরশ মনি গার্মেন্টসের মালিক মিজানুর রহমান ও তার স্ত্রী তাছলিমা আজাদ, জামির পরিমাণ ৪১ শতক এখানে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। অপর দলিল নং-১৬০, গ্রহিতা কোটচাঁদপুর এলাঙ্গী ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খান ও তার স্ত্রী মেহরিন আক্তার, জমির পরিমাণ ১৯৯ শতক ৫০ পয়েন্ট। জমির মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। চুপিসারে জমি বিক্রয়ের বিষয়টি মাত্র কয়েকদিন আগে চাউর হয়ে পড়লে এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি হয়ে কিভাবে জমি রেজিস্ট্রি করে তা নিয়ে এলাকার মহল্লায় মহল্লায় চায়ের দোকান, রেস্তোঁরা ও হোটেলগুলিতে পুলিশ প্রশাসনসহ সাব রেজিস্ট্রারের ভূমিকা নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন।

বিষয়টি নিয়ে সাব রেজিস্ট্রার অঞ্জনা রানী বলেন- আদালত থেকে যেহেতু এ ধরনের আসামির জমি বিক্রির বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা আমাদেরকে দেওয়া হয়নি সেহেতু আমি কোনো কিছুই খতিয়ে দেখি নাই, তাছাড়া তাকে আমি চিনি না। তিনি বলেন, ফারুক আহমেদ কাজল প্রকাশ্যে রেজিস্ট্রির দিনে আমার দপ্তরে এসে শনাক্তকারীর মাধ্যমে তিনি জমি রেজিস্ট্রি করে গেছেন।

এ ব্যাপারে কোটচাঁদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী কামাল হোসেন বলেন- কাজল কোটচাঁদপুরে জমি রেজিস্ট্রি করতে এসেছিল এ ধরনের তথ্য আমার জানা নেই। আর জমি রেজিস্ট্রির বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে যেহেতু সাব রেজিস্ট্রার একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি সেহেতু এ ধরনের একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামির বিষয়ে আমাদেরকে জানানো উচিৎ ছিল।

জমি ক্রেতারা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। তাদের ধারণা পত্রিকায় নাম আসলে তাদের ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসতে পারে!

যে কারণে অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন- পুলিশ প্রশাসন ও সাব রেজিস্ট্রারকে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। অপরদিকে রেজিস্ট্রি অফিস সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, হুন্ডি কাজল রেজিস্ট্রি অফিসে এসেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। তাদের সাফ কথা বিষয়টি সাব রেজিস্ট্রার স্যার ভালো জানেন। তবে রেজিস্ট্রি অফিসের একটি সূত্র থেকে জানায়, হুন্ডি কাজল কোটচাঁদপুরে আসেনি। আগে থেকে রেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতিবাজ দলিল লেখক বদর উদ্দীনের মাধ্যমে দলিল তৈরি করে সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর থানার গয়েশপুর গ্রামের হুন্ডি কাজলের এক আত্মীয় বাড়ি থেকে দলিলে হুন্ডি কাজলের সহি করে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে সাব রেজিস্ট্রার ওই দলিল রেজিস্ট্রি করতে অসম্মতি জানালে তাকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। ফলে তিনি রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য হন। ওই সূত্রের দাবি বিষয়টি তদন্ত করলে প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হবে।

এ অঞ্চলের অগণিত মানুষের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হলে তাদেরও একই ধারণা হুন্ডি কাজল কখনোই কোটচাঁদপুরে এসে জমি রেজিস্ট্রি করার সাহস করবে না। তা ছাড়া অফিস চলাকালে সময়ে শত শত মানুষ ওখানে উপস্থিত থাকে। সেখানে হুন্ডি কাজল এসে জমি রেজিস্ট্রি করবে এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। বিষয়টি তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শরিফুন্নেছা মিকি বলেন, হুন্ডি কাজল কোটচাঁদপুরে এসেছিল বলে আমার জানা নেই। এ ধরনের দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোটচাঁদপুরে এসে জমি রেজিস্ট্রি করবে আমার ধারণার বাইরে। বলতে গেলে আমি ধুয়াসার মধ্যে আছি।

বিষয়টি নিয়ে কোটচাঁদপুর পৌর মেয়র জাহিদুল ইসলাম বলেন, হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে এমন প্রতারণার হুন্ডি কাজল ও তার এজেন্টদের বিচার হওয়া উচিৎ। আমি আশাবাদী দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার অচিরেই তা করবেন।

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান গনমাধ্যম কর্মীদের জানান, হুন্ডি কাজল সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। এ অবস্থায় তিনি তার কোন সম্পদ বিক্রি করতে পারেন না। যদি করেনও তবে তা হবে অবৈধ ও দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সাব রেজিস্ট্রার দায়ী থাকবেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কেও অভিযোগ দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করবেন।

প্রসঙ্গত, হুন্ডি কেন্দ্রিক সমস্যা দীর্ঘ ১৯টি বছর ঝুলে আছে। এ সমাধানে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের দিয়ে যাওয়া কথা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ১৯ বছর ধরে হুন্ডির ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ।

হুন্ডি কাজলের বর্তমান কোটিপতি হুন্ডি এজেন্টদের এমন এক সময় ছিল এরা কেউ কেউ পরের দোকানে কাজ করতো, কেউ কেউ চোরাচালানির মালামাল ভারত থেকে আনা নেওয়ার জন্য কামলা খাটতো, কেউ দিনমজুরের কাজ করতো তারা আজ সাধারণ মানুষের টাকা লুটে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছে। অথচ কাজল ও তার এজেন্টদের কারণে হুন্ডিতে লগ্নি করে কোটচাঁদপুরসহ কমপক্ষে ২০ জেলার হাজার হাজার মানুষ আজ পথে বসেছে। কেউ চাকরির পেনশনের টাকা লগ্নি করে কামলা খাটছে, কেউ সম্পদ বিক্রি করে, কেউ ব্যবসার টাকা লগ্নি করে সব খুঁইয়ে নিঃস্ব হয়ে আজ দিনমজুরের কাজ করছে। অনেক মেয়ে তালাকপ্রাপ্ত হয়েছে। এরই মধ্যে অনেকে অভাবের তাড়নায় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। এমনকি হুন্ডি কেন্দ্রিক হত্যার ঘটনাও ঘটেছে একাধিক। হুন্ডি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কোটচাঁদপুর শহরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি ঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার পাশাপাশি ৩ থেকে ৪ দিন ধরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। হরতাল চলেছে বেশ কয়েক দিন।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের আলোচিত হুন্ডি প্রধান ফারুক আহমেদ কাজল ও তার প্রায় দুই শতাধিক নিয়োগকৃত এজেন্টদের নিয়ে গঠন করা হুন্ডি ব্যবসা শুরু হয় ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে। লগ্নিকারীদের ১ লাখে ১০ হাজার টাকা লাভ দেওয়া হত। ১৯৯৯ সালের প্রথম থেকে ১ লাখে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পঙ্গু পালের মতো মানুষ ছুটে আসে কোটচাঁদপুরে হুন্ডি এজেন্টদের মাধ্যমে কাজলের হুন্ডি ব্যাংকে টাকা লগ্নি করতে। এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ২০০০ সালের প্রথম দিকে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।

টাকা হারিয়ে লগ্নিকারীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ সুযোগে সুযোগ সন্ধানি কিছু ব্যক্তি শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। বিষয়টি নিয়ে হাজার হাজার লগ্নিকারীরা কোটচাঁদপুরে আন্দোলনে নেমে আসে। টাকা উদ্ধারের দাবিতে চলে একের পর এক হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি। এমন ঘটনায় দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ওই সময় ছুটে আসেন কোটচাঁদপুরে সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।

তিনি কথা দিয়ে যান লগ্নিকারীদের টাকা ফেরত দেওয়াসহ হুন্ডি কাজল ও তার এজেন্টদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। কিন্তু তার পরও তিন তিন বার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলেও লগ্নিকারীদের কোনো কাজে আসেনি। যে কারণে এ অঞ্চলে অনেকটাই আস্তা সংকটে বর্তমান সরকারের দলটি। তাই এলাকার স্বচেতন মহল মনে করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপই পারে হাজার হাজার অসহায় মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনাসহ এ সমস্যার সমাধান দিতে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button