টপ লিডশৈলকুপা

ঘুরে আসুন কবি গোলাম মোস্তফার ঝিনাইদহের বাড়ি: জীবণী ও সাহিত্যকর্ম

আব্দুর রহমান মিল্টন, ঝিনাইদহের চোখঃ

বিশ^নবীর রচয়িতা কবি গোলাম মোস্তফার গ্রামের বাড়িটি দেখতে প্রতি নিয়ত আসে অসংখ্য মানুষ । ছায়াঘেরা মনোহর দৃশ্যের মনোহরপুর গ্রামে এখনো রয়েছে ঐতিহ্যবাহী কবির সেই কাচারী ঘর। কবির টিনসেড ২টি বাড়ি, কবির ব্যবহৃত খাঁট সহ বেশকিছু আসবাবপত্র । কবির স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির সেই পুরাতন আমগাছ, আমবাগিচা,জামরুল গাছ, পুকুর । এছাড়া পরবর্তীতে একটি স্মৃতিপাঠাগার খোলা হয়েছে । এখানে কবিপুত্র চিত্রশিল্পী মোস্তফা আজিজের চিত্রশালাও রয়েছে।

কবি গোলাম মোস্তফা তার সময়ের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি । বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য ইতিহাসে তাঁর অবদান অবিস্মরনীয় । তিনি ইসলামকেই তার আদর্শ হিসাবে বেছে নিয়েছেন । তবে তিনি অনুদার ও সাম্প্রদায়িক ছিলেন না । তিনি নিজেই লিখেছেন ‘সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিও তাগিদে নয় সহজভাবেই আমি বাংলা সাহিত্যে চেয়েছিলাম ইসলামী কৃষ্টির রুপায়ন’ । ১৯৫৭ সালে বরিশাল সাহিত্য সম্মেলনে ইসলামী সাহিত্য বিষয়ক এক অভিভাষণে বলেছিলেন “ ইসলাম নিজেই যখন মিলন ও সমন্বয় প্রয়াসী তখন ইসলামী সাহিত্য কেন হবে সংকীর্ণ ও অনুদার ? ইসলামী কোন জিনিষই তো সংকীর্ণ বা অনুদার নয় । দেশই হোক জাতিই হোক ধর্মই হোক সাংস্কৃতিই হোক সমাজই হোক শিল্পই হোক ইসলাম সর্বত্রই মিলেছে ও মিলিয়েছে। খন্ডতা ও ক্ষুদ্রতার স্বপ্ন যেখানেই ভিড় জমিয়েছে সেখানেই প্রয়োজন হয়েছে ইসলামের। সকলের জন্য স্থান সংকুলান করাই তো ইসলামের কাজ” ।
এই কবি সম্পর্কে ডক্টর মহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন ‘ বাংলা ভাষায় অনেক মুসলমান লেখক ও কবি আছেন কিন্তু আমার বিবেচনায় ইসলামী সাহিত্য রচনায় তার অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে’। হযরত মুহম্মদ (সঃ) এর জীবনী গ্রন্থ ‘বিশ^নবী’ কবি গোলাম মোস্তফা রচিত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি । তিনি যদি অন্য কিছু ন্ওা লিখতেন তবুও যুগের পর যুগ, শতাব্দির পর শতাব্দি বাঙালী পাঠক তথা মুসলিম পাঠকদের কাছে বেঁচে থাকতেন ।
কবির লেখা বিভিন্ন কবিতা প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে পাঠ্যপুস্তকের অন্তভর্’ক্ত। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’- কবির লেখা এই বিখ্যাত কাব্য পংক্তিটি প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে।

জন্ম ও শৈশব-
কবির ‘আমার জীবন স্মৃতি’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায় ১৮৯৫ সালে(সার্টিফিকেট১৮৯৭) যশোর (বর্তমান ঝিনাইদহ) জেলার শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ।
এই গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত কুমার নদ এবং পূর্ব পাশের্^ দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ- এই দুয়ের মাঝখানে ছবির মতো ছোট্ট মনোহরপুর গ্রামেই কবির শৈশব-কৈশর কাটে।

লেখাপাড়া ও পেশা:
লেখাপড়ার পাঠ শুরু হয় নিজবাড়িতে, তারপর পাশের গ্রাম দামুকদিয়াতে পাঠশালায় লেখাপড়ার আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি কবির। ১৯১৪ সালে স্থানীয় শৈলকুপা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এরপর ১৯১৬সালে খুলনার দৌলতপুর কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯১৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। ১৯২০ সালে ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে ডেভিট হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.টি ডিগ্রী লাভ করেন । কবি পেশায় ছিলেন একজন শিক্ষক। দীর্ঘ ৩০বছর বিভিন্ন স্কুলে সহকারী এবং হুগলী কলোজিয়েট স্কুল, ফরিদপুর জেলাস্কুল সহ বিভিন্ন স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব সুনামের সঙ্গে পালন করেন। এরপর ১৯৫০ সালে স্বেচ্ছায় প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ।

সাহিত্যের সূচনা-
কবির পিতা মরহুম গোলাম রব্বানী ছিলেন গ্রামের স্কুল মাষ্টার ও পল্লী কবি । তার পিতা মহও ছিলেন একজন কবি ও শিক্ষানুরাগী। এই পরিবারে আরবী, ফারসি, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নিয়মিত চর্চা হতো । কবির উপর এই পারিবারিক ঐতিহ্য দৃড়ভাবে প্রভাব বিস্তার করে । তার মধ্যে কাব্যিক ভাব আসে । কবির বয়স যখন ১৩ বছর তখন থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। দশম শ্রেণীতে উঠলে ‘আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ নামে তার লেখা এ কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ১৯১৩ সালে । কবিতাটি পাঠক মহলে সাড়া জাগায়। এরপর থেকে কাব্য, উপন্যাস, জীবনী, অনুবাদ ইত্যাদি সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তিনি স্বচ্ছন্দ পদাচরণা করেছেন।
কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ রক্তরাগ(১৯২৪ ইং) পড়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে দু’লাইন কবিতা লিখে বরণ করে নেন । কবি গুরু লিখেছেন ‘‘তব নব প্রভাতের রক্তরাগ খানি/মধ্যাহ্নের জায়গায় যে জ্যোতির্ময়ী বাণী’’।

সাহিত্য কর্ম-
কাব্যগ্রন্থ: রক্তরাগ, হা¯œাহেনা,খোশরোজ,কাব্যকাহিনী, সাহারা, শেষ ক্রন্দন, বুলবুলিস্থান,তারানা-ই-পাকিস্থান, বনি আদম । অনুবাদগ্রন্থ: গদ্য- এখওয়ানুস সাফা, কবিতা-মুসাদ্দাস-ই-হালী, কালামে ইকবাল, শিকওয়া,আলকুরআন। জীবনী গ্রন্থ: বিশ^নবী, আবুবকর, মরুদুলাল । প্রবন্ধগ্রন্থ: আমার চিন্তাধারা, গোলাম মোস্তফা প্রবন্ধ সংকলন, ইসলাম, বিশ^নবীর বৈশিষ্ট্য, ইসলাম ও কমিউনিজম, ইসলামে জেহাদ । উপন্যাস: রুপের নেশা,ভাঙ্গাবুক । গল্প: জয়পরাজয় । গান: গীত সঞ্চায়ন । পাঠ্যপুস্তক: আলোকমালা, আলোক মুঞ্জুরী, মঞ্জু লেখা, মনি মুকুর, খোকা খুকুর বই, নতুন বাংলা ব্যাকরণ । এর মধ্যে ‘মঞ্জু লেখা’ এবং ‘মনি মুকুর’ যৌথভাবে কথা শিল্পী মনোজ বসুর সাথে লেখা ।
তখনকার সময়ে ইংরেজী সাহিত্যেও তার যথেষ্ট অবদান ছিল । ইংরেজীতে কবির লেখা অনেক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হত। গীতিকার ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবেও কবির খ্যাতি ছিল । তিনি বিভিন্ন সময়ে যৌথভাবে পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। সাহিত্য সংগঠন এবং বিভিন্ন সমাজ উন্নয়ন মুলক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।

যত পুরষ্কার-
যশোরবাসীর পক্ষ থেকে ১৯৫১ সালে কবি কে ‘কাব্য সুধাকর’ উপাধি, ১৯৫৮ সালে পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট পুরষ্কার চজওউঊ ঙঋ চঊজঋঙজ গঅঘঈঊ লাভ, ১৯৬০ সালে রাষ্ট্রের পক্ষে ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব, ১৪০৪ হিজরীতে কবি কে মরনোত্তর ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরষ্কারে ভ’ষিত করা হয় ।
বিবাহিত জীবনে কবি গোলাম মোস্তফা ৪ পুত্র এবং ৩ কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন । ১৯৬৪ সালের ৮অক্টোবর তিনি হঠাৎ সেরিব্রাল থ্রম্বসিস রোগে আক্রান্ত হন এবং ১৯৬৪ সালের ১৩অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন ।

যেভাবে আসবেন:
ঢাকা থেকে ঝিনাইদহের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার আর গন্তব্য পর্যন্ত অর্থাৎ শৈলকুপা পৌঁছাতে আর ১৮ কিলোমিটার যেতে হয়।
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রতিদিন ঝিনাইদহ ও শৈলকুপার উদ্দেশে বেশ কিছু এসি, ননএসি পরিবহন ছেড়ে আসে। আবার ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ফিরে যায়। এসব পরিবহনের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স, রয়েল পরিবহন, জে আর পরিবহন, পূর্বাশা, মেহেরপুর ডিলাক্স, দর্শনা ডিলাক্স, ঝিনাইদহ লাইন অন্যতম। এ ছাড়া আরো ২০/২৫ ধরনের দূরপাল্লার পরিবহন নিয়মিত আসা-যাওয়া করে।
পূর্বাশা পরিবহনের এসি গাড়িগুলো প্রতিদিন ঢাকার মাজার রোড ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল সাড়ে ৯টায়, সাড়ে ১১টায়, দুপুর পৌনে ১টা, বিকেল ৩টা ৪৫, ৪টা ৪৫, রাত ৮টা ৩০ ও রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে ছেড়ে আসে।
পাঁচ ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে ঢাকা থেকে ঝিনাইদহ পৌঁছে যায় এসব পরিবহন, তবে দৌলদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে কখনো কখনো জ্যামে আটকে পড়লে আরো দেড় ঘণ্টা বেশি সময় লাগে। ফেরী পারাপার বাদেও বাসে চেপে ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ- যমুনা সেতু হয়ে কুষ্টিয়া এরপর ঝিনাইদহে আসা যায় ।

যেখানে থাকা যাবে:
কবি গোলাম মোস্তফার গ্রামের বাড়ি মনোহরপুর শৈলকুপা উপজেলা শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। গ্রামে এসে কবির বাড়ির কাচারী ঘর বা আশপাসে এক-আধবেলা বিশ্রাম নেওয়া যায়, আশপাশে কিছু দোকানপাট রয়েছে, হালকা নাশতা করা যায়। তবে রাতে থাকার জন্য শৈলকুপা উপজেলা শহরে কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি রেস্টহাউস রয়েছে। এ ছাড়া জেলা পরিষদ ডাকবাংলো রয়েছে । ২শ থেকে ৩শ টাকার মধ্যে থাকতে পারবেন এসব স্থানগুলিতে ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button