ধর্ম ও জীবন

মহানবী (সা.) ও জয়নব (রা.)-এর ঐতিহাসিক বিয়ে

ঝিনাইদহের চোখঃ

মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে জনয়ব (রা.)-এর বিয়ের পেছনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। ঘটনাটি হলো—এর আগে মহানবী (সা.)-এর পালক পুত্র জায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে জয়নব (রা.)-এর বিয়ে হয়েছিল। জাহেলি যুগে পালক পুত্রকে নিজের ঔরসজাত পুত্রের মতো মনে করা হতো। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, জায়েদ (রা.) সিরিয়ায় বন্দি হন। হাকিম ইবনে হেজাম ইবনে খুয়াইলিদ তাঁকে ক্রয় করে স্বীয় ফুফু খাদিজা (রা.)-কে দান করেন। খাদিজা (রা.) মহানবী (সা.)-এর খেদমতের জন্য তাঁকে দান করেন। মহানবী (সা.) জায়েদ (রা.)-কে আজাদ করে দিয়ে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। জায়েদ (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছে দীর্ঘদিন ধরে পুত্রের মতো বসবাস করতে থাকেন। তাঁর পিতা দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাঁর অনুসন্ধান করার পর অবশেষে তাঁর সন্ধান পান। অতঃপর তাঁর পিতা ও চাচা অর্থের বিনিময়ে মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে তাঁদের সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আবেদন করেন। মহানবী (সা.) বলেন, তোমরা ইচ্ছা করলে বিনিময় ছাড়া তাকে নিয়ে নিতে পারো অথবা ইচ্ছা করলে আমার কাছেও রেখে যেতে পারো। জায়েদ (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছে থেকে যেতে চান এবং তাঁরাও মহানবী (সা.)-এর কাছে রেখে যাওয়াকে পছন্দ করেন। মহানবী (সা.) তখন বলেন, হে কুরাইশ গোত্র! তোমরা সাক্ষী থাকো! জায়েদ আমার পুত্র, সে আমার ওয়ারিশ হবে। আর আমিও তার ওয়ারিশ হব। অতঃপর তাঁর পিতা ও চাচা খুশি হয়ে দেশে ফিরে যান। বলা বাহুল্য যে রাসুল (সা.)-এর এ ঘোষণা ছিল নবুয়তপ্রাপ্তির আগে।

অষ্টম হিজরির জমাদিউল আউয়াল মোতাবেক ৬২৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত মুতার যুদ্ধে সিরিয়ায় জায়েদ (রা.) শহীদ হন। মুতার যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে সেনাপতি নিয়োগ করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মুতার যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে আমার ছেলে জায়েদ, সে শহীদ হলে জাফর, সে শহীদ হলে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। এ যুদ্ধে তিনজনই শহীদ হন। তাঁদের শহীদ হওয়ার সংবাদ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ পৌঁছলে তিনি ক্রন্দন করেন এবং শোক প্রকাশ করেন।

পুত্র বলে স্বীকার করলে পুত্র হয় না : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাকো। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সংগত। যদি তোমরা তাদের পিতৃপরিচয় না জানো, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য হবে।’ (সুরা : সিজদা, আয়াত : ৫) মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে স্বীয় পিতা ছাড়া অন্যের বলে ডাকে, তার জন্য বেহেশত হারাম।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৩২৬)

আবু জর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, কাউকে স্বীয় পিতা ছাড়া অন্যের বলে ডাকা জায়েজ নয়। যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে ডাকল, সে কুফরি করল।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৫০৮)

জাহেলি যুগের প্রথা ছিল যে যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কারো পুত্রকে পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করত, তাহলে এ পোষ্যপুত্র তার প্রকৃত পুত্র বলে গণ্য হতো। এ পোষ্যপুত্র সব ক্ষেত্রে প্রকৃত পুত্রের মর্যাদাভুক্ত হতো। তারা প্রকৃত সন্তানের মতো সম্পদের অংশীদার হতো এবং বংশ ও রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে যেসব নারীর সঙ্গে বিয়ে-শাদি হারাম, এ পোষ্যপুত্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এরূপ মনে করা হতো। বিয়েবিচ্ছেদ সংঘটিত হওয়ার পর ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করা যেরূপ হারাম, অনুরূপভাবে পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীও হারাম বলে মনে করা হতো। ইসলাম চিরতরে এ প্রথাকে বিলুপ্ত করেছে।

জয়নবের সঙ্গে জায়েদের বিয়ে : জায়েদ বিন হারেসা (রা.) যৌবনে পদার্পণ করলে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় ফুফাতো বোন জনয়ব বিনত জাহশকে তার কাছে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠান। জায়েদ (রা.) যেহেতু মুক্তিপ্রাপ্ত দাস ছিলেন, সেহেতু হজরত জনয়ব ও তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ এ বিয়েতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন, আমরা বংশমর্যাদায় তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তখন আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাজিল করেন—‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো কাজের আদেশ করলে যে তা অমান্য করে, সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টাতায় পতিত হয়।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৬) জনয়ব ও তাঁর ভাই এ আয়াত শুনে তাঁদের অসম্মতি প্রত্যাহার করে নিয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যান। অতঃপর চতুর্থ হিজরিতে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এ বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হয় ১০ দিনার, যা প্রায় চার ভরি স্বর্ণ পরিমাণ ও ৬০ দিরহাম বা ১৮ তোলা রৌপ্য পরিমাণ। তা ছাড়া দেওয়া হয়েছিল একটি ভারবাহী জন্তু, কিছু গৃহস্থালির আসবাবপত্র, আনুমানিক ২৫ সের আটা ও পাঁচ সের খেজুর। মহানবী (সা.) নিজের পক্ষ থেকে তা প্রদান করেছিলেন। (ইবনে কাসির) মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ মোতাবেক জায়েদ বিন হারেসার সঙ্গে জয়নব (রা.)-এর বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু তাদের স্বভাব-প্রকৃতিতে মিল হয়নি। জায়েদ (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছে জনয়ব (রা.) সম্পর্কে ভাষাগত শ্রেষ্ঠত্ব, গোত্রগত মর্যাদা ও আনুগত্যে শৈথিল্য প্রদর্শনের অভিযোগ উত্থাপন করেন।

মহানবী (সা.)-এর কাছে ওহি : মহানবী (সা.)-কে ওহির মাধ্যমে জানানো হয় যে জায়েদ (রা.) জনয়ব (রা.)-কে তালাক দিয়ে দেবেন। অতঃপর আপনি তাঁর পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবেন। একদা হজরত জায়েদ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে এসব অভিযোগ পেশ করতে গিয়ে হজরত জনয়বকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মহানবী (সা.) যদিও ওহির মাধ্যমে অবগত হয়েছিলেন, তার পরও দুটি কারণে তিনি তালাক দিতে নিষেধ করেন। একটি হলো—তালাক দেওয়া যদিও শরিয়তে জায়েজ, কিন্তু তা অপছন্দনীয় কাজ। অপরটি হলো, মহানবী (সা.)-এর অন্তরে এরূপ ধারণা সৃষ্টি হয় যে জায়েদ তালাক দেওয়ার পর যদি তিনি জয়নবের পাণি গ্রহণ করেন, তবে আরববাসী বর্বর যুগের প্রচলিত প্রথানুযায়ী এ অপবাদ রটাবে যে রাসুল (সা.) পুত্রবধূকে বিয়ে করেছেন।

মহানবী (সা.) পঞ্চম হিজরিতে মদিনায় জনয়বকে বিয়ে করেন। তখন রাসুল (সা.)-এর বয়স ছিল ৫৮ বছর, আর জনয়ব (রা.)-এর বয়স ছিল ৩৫ বছর। এ বিয়ে হয়েছিল সরাসরি আল্লাহ তাআলার নির্দেশে। তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন, আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন, তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো। তখন আপনি (আপনার) অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিয়েছেন (যে দত্তক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে পত্নিত্বে বরণ করতে হবে)। আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন, অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর জায়েদ যখন জয়নবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ করলাম। যাতে পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে মুমিনদের অন্তরে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব্ব না থাকে। (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৭)

জনয়ব (রা.)-কে মহানবী (সা.) বিয়ে করলে মুনাফিকরা বিরোধিতার মহা উপকরণ হাতে পায়। তারা প্রচার করতে থাকে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) এতই নারীলোলুপ যে স্বীয় পুত্রবধূকে পর্যন্ত বিয়ে করেছেন। তখন আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাজিল করেন, মুহাম্মদ তোমাদের কোনো ব্যক্তির পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত (সুরা : আল-আহজাব : ৪০)

আরো ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাকো। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সংগত। যদি তোমরা তাদের পিতৃপরিচয় না জানো, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য হবে।’

বহু বিয়ের প্রথা নতুন নিয়ম নয় : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আল্লাহর নবীর জন্য (একাধিক বিয়ের ব্যাপারে) যা নির্ধারণ করেছেন, তাতে তাঁর কোনো বাধা নেই। আগের নবীদের ক্ষেত্রে এটাই ছিল আল্লাহর চিরাচরিত নিয়ম। আল্লাহর আদেশ নির্ধারিত, অবধারিত। (সুরা : আল আহজাব, আয়াত : ৩৮) যেমন দাউদ (আ.)-এর ছিল ১০০ জন পত্নী, ৩০০ জন উপপত্নী। হজরত সুলাইমান (আ.)-এর ছিল ৩০০ পত্নী এবং ৭০০ জন উপপত্নী।

জয়নব (রা.)-এর বিয়ের বৈশিষ্ট্য : এ বিয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো : ১. এ বিয়ে হয়েছিল আল্লাহ তাআলার নির্দেশে। হজরত জনয়ব (রা.) অন্যান্য স্ত্রীদের ওপর গর্ব করে বলতেন, তোমাদের বিয়ে সম্পন্ন করেছেন তোমাদের পিতারা, আর আমার বিয়ে সম্পন্ন করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। (নাসায়ি) ২. পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করা যাবে না, জাহেলি যুগের এ কুসংস্কারকে এ বিয়ের মাধ্যমে রহিত করা হয়েছে। ৩. দাস ও স্বাধীনদের মধ্যে সমতা আবশ্যক, তা এ বিয়ের ফলে প্রতীয়মান হয়েছে। ৪. এ বিয়ের পর পর্দার আয়াত তথা সুরা আল আহজাবের ৫৩ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। তখন থেকে রাসুল (সা.) স্ত্রীদের দরজায় কম্বলের পর্দা ঝুলিয়ে দেন। ৫। হজরত জনয়ব (রা.) বলেন, আমার তিনটি বৈশিষ্ট্য। তা হলো : ক) আমার দাদা ও রাসুল (সা.)-এর দাদা একজন। খ) আমার বিয়ে হয়েছে আকাশে। গ) আমার বিয়েতে দূতের কাজ করেছেন স্বয়ং জিবরাঈল (আ.)। ৬) কোরআন মাজিদের কোথাও জায়েদ ইবন হারেসার নাম ছাড়া অন্য কোনো সাহাবির নাম নেই।

লেখক : প্রধান ফকিহ

আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button