ধর্ম ও জীবন

মহান আদর্শের মহানায়ক

মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন সব শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য এক অনুপম আদর্শ। তিনি ছিলেন শিশুর আদর্র্শ, যুবকের আদর্র্শ, সৈনিকের আদর্র্শ, সেনাপতির আদর্শ, স্বামীর আদর্র্শ, পিতার আদর্র্শ, নানার আদর্র্শ, ব্যবসায়ীর আদর্র্শ, শিক্ষকের আদর্র্শ এবং রাষ্ট্রনায়কেরও আদর্র্শ। জীবনের সব অঙ্গনেই তিনি তাঁর মহান আদর্শের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন তাঁর উন্নত চরিত্র ও আদর্শে পূর্ণতা বিধানের লক্ষ্যে। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে সচ্চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তেই প্রেরণ করা হয়েছে।’ (জামেউল আহাদিস : ৬৭২৯)। পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষের মধ্যে এমন পরিপূর্ণ আদর্শ পাওয়া যাবে না যা শুধু মহানবীর জীবনাদর্শেই বিদ্যমান। এ জন্য একমাত্র তাঁর অনুসরণ-অনুকরণের মাঝেই রয়েছে মানব জীবনের ঐকান্তিক সফলতা।

মানবজাতির একমাত্র আদর্শ মহানবী (সা.) ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। মহানবী (সা.) এর চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সূরা কালাম : ৪)। মহানবীর নৈতিক চরিত্রের মান নিয়ে মক্কার মুশরিকদের কোনো অভিযোগ ছিল না। তাঁর বিশ্বস্ততা ও উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারেও মুশরিকদের ভিন্নমত ছিল না। কোরআনে যে নৈতিক গুণাবলিকে উৎকৃষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি ছিলেন তার জীবন্ত নমুনা। প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি চরম শত্রুকে ক্ষমা করে দিতেন। মক্কা বিজয়ের দিনে রাসূল (সা.) মক্কার লোকদের উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘হে কোরাইশরা! তোমরা আমার থেকে আজ কেমন ব্যবহার আশা কর?’ তারা বলল, সম্মানিত ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মতো! তিনি বললেন, ‘তোমরা আজ মুক্ত!’ যারা একসময় তাকে অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছিল, সামাজিকভাবে বয়কটসহ হত্যার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিল, তিনি তাদের নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিলেন। একবার রাসুল (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে মসজিদে বসা ছিলেন, এমন সময় একজন বেদুইন এসে সেখানে প্রস্রাব করা শুরু করল। সাহাবিরা তাকে ধমক দিয়ে থামতে বললেন। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও; বাধা সৃষ্টি করো না।’ তারপর তিনি লোকটিকে ডেকে বললেন, ‘এটা পবিত্র মসজিদ, এ স্থান অপবিত্রতা কিংবা প্রস্রাব-পায়খানার জন্য উপযুক্ত নয়।’ অতঃপর রাসুল (সা.) একজন সাহাবিকে বললেন, তুমি পানিভর্তি একটি বালতি নিয়ে আসো এবং এখানে ঢেলে দাও। (মুসনাদে আহমাদ : ১২৯৮৪)।

শারীরিক সমস্যা হতে পারে এ চিন্তা থেকেই রাসুল (সা.) লোকটিকে প্রস্রাব করার মাঝে বাধা দিতে নিষেধ করলেন; ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের সঙ্গে ইসলাম কি ব্যবহার করতে বলেছে, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে রয়েছে।

অধীনদের প্রতি মহানবীর ব্যবহার রাসুল (সা.) স্ত্রীদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন স্ত্রীদের কাছেও একজন আদর্শবান স্বামী। এ প্রসঙ্গে তিনি এরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম এবং আমি তোমাদের মাঝে তোমাদের চেয়ে আমি আমার স্ত্রীদের কাছে উত্তম। (ইবনে মাজাহ : ১৯৭৭)। তিনি তাঁর অধীন কাজের লোকদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। অধীন কাজের লোকদের ভাই বলে স্বীকৃতি দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের মতো সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন।

তিনি এরশাদ করেছেন, তারা হচ্ছে তোমাদের ভাই ও তোমাদের খাদেম। মহান আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা তাকে তাই খাওয়াবে যা সে নিজে খাবে, তাই পরাবে যা সে নিজে পরবে। সামর্থ্যরে বাইরের কাজের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দিও না। আর এ ধরনের কাজের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দিলে তাদের সাহায্য করো।’ (বোখারি : ১৩৬০)। তিনি কখনও কোনো কাজের লোককে মারধর করেননি। হজরত আনাস (রা.) শিশু অবস্থায় রাসুল (সা.) এর খাদেম হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি একটানা ১০টি বছর রাসুল (সা.) এর সেবায় নিয়োজিত ছিলাম। এ সুদীর্ঘ সময়ে রাসুল কখনোই আমার প্রতি বিরক্ত প্রকাশ করে উফ শব্দটুকু উচ্চারণ করেননি। আমার কোনো কাজ দেখে কখনও বলেননিÑ তুমি এ কাজ করলে কেন? কিংবা কাজ না করলে কখনও বলেননিÑ তুমি এ কাজ করলে না কেন? (বোখারি : ৫৬৯১)। এজন্যই মহানবীর চরিত্রকে মানব জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুল (সা.) এর আদর্শ তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।’ (সূরা আহজাব : ২১)।

যে আদর্শে রয়েছে সফলতা
জীবনে সফলতা পেতে হলে তাঁর আদর্শের পূর্ণ অনুসারী হতে হবে। তাঁর আদর্শ বাদ দিয়ে অন্য কারও আদর্শ অনুসরণ করে জীবনে সফল হওয়া যাবে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে সে অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে।’ (সূরা আহজাব : ৭১)। আবার জান্নাতপ্রাপ্তির জন্য রাসুল (সা.) এর অনুকরণের শর্তারোপ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে আল্লাহ তাকে এমন জান্নাতগুলোতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশ দিয়ে নহরগুলো প্রবহমান। আর সেটিই হচ্ছে প্রকৃত সফলতা।’ (সূরা নিসা : ১)।

মুক্তিকামীদের আদর্শ
মহানবী (সা.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে সবার জন্য অনুসরণীয় ও মুক্তির কান্ডারি হিসেবে। আল্লাহর ভালোবাসা প্রাপ্তিও মহানবীর পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণের ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাস তাহলে আমার অনুসরণ করো। তবে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৩১)। রাসুল (সা.) কে ভালোবাসার নিদর্শন হচ্ছে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করা। তাঁর সুন্নত বা আদর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন না করে নিজেকে আশেকে রাসুল দাবি করা এক বড় ধরনের মিথ্যাচার।

রাসুল (সা.) কে অনুসরণের অর্থ হলোÑ ধর্মীয় জীবন থেকে ব্যক্তিজীবন, সমাজ জীবনসহ জীবনের সব অঙ্গনে একমাত্র তাঁর আদর্শ মেনে চলা। তাঁর আদর্শের অনুসারী না হলেও রয়েছে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি, ‘যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের নাফরমানি করবে অবশ্যই তার শাস্তি হলো জাহান্নাম, সে সেখানে চিরকাল থাকবে।’ (সূরা জিন : ২৩)। যারা রাসুলের আদর্শের বিরোধিতা করবে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার সতর্কবার্তা হচ্ছে, যারা নবী (সা.) এর আদর্শের বিরুদ্ধাচারণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের স্পর্শ করবে, যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদের গ্রাস করবে।’ (সূরা নূর : ৬৩)। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) এর ঘোষণা হচ্ছে, ‘আমার উম্মতের সব লোকই জান্নাতি হবে অস্বীকারকারী ব্যতীত।’

জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! অস্বীকারকারী কে? রাসুল (সা.) বললেন, ‘যে আমার অনুসরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার আদর্শের বিরোধিতা করবে সে অস্বীকারকারী তথা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (বোখারি : ৬৮৫১)।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button