ধর্ম ও জীবন

সম্পদের ভালোবাসা ফেতনা সৃষ্টির কারণ

মাওলানা আবদুস সবুর

পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ফেতনা সৃষ্টি হওয়ার অসংখ্য কারণ বর্ণিত আছে। উত্তরণের পথও শরিয়ত বাতলে দিয়েছে।
সামাজিক গ-গোল, রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা-অশান্তি সৃষ্টি হয় বড় কয়েকটি কারণে। এগুলো দূর হলে, পরস্পরের মারামারি-হানাহানি, গ-গোল-বিশৃঙ্খলা ও ফেতনা-ফ্যাসাদ বন্ধ হয়ে যাবে।
হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেনÑ ‘দানসদকা সম্পদ কমায় না। কাউকে ক্ষমা করলে আল্লাহ তায়ালা তার সম্মান বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহর জন্য নিজেকে ছোট করলে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’ (মুসলিম : ৪৬৮৯)।

সম্পদের মহব্বতের কারণে গ-গোল হয়। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি কেন হচ্ছে? সুদ-ঘুষ কেন নিচ্ছে? চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই করছে কেন? সম্পদের মহব্বতের কারণেই এসব হচ্ছে। সম্পদ দরকার; কিন্তু অন্তরে এর মহব্বত থাকা চলবে না। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেনÑ ‘দুনিয়ার মহব্বত সব অন্যায়ের মাথা-মূল।’ (মেশকাত : ৫২১৩)।

সব অন্যায়ের মাথা হলো দুনিয়ার মহব্বত, সম্পদের মহব্বত। বোঝা গেল, মালের মহব্বতের কারণে ফ্যাসাদ হয়, পরস্পরের মধ্যে হানাহানি হয়।
বলা হয়ে থাকেÑ ‘দুনিয়া মৃত প্রাণীর মতো। এর অন্বেষণকারীরা কুকুরের মতো।’ কুকুর যেমন মরা গরু নিয়ে কামড়াকামড়ি করে, দুনিয়ার ধন-দৌলতের মহব্বত যাদের অন্তরে আছে, তারাও তেমনি পরস্পর হানাহানি করে, মারামারি করে। এ কারণে ফেতনা-ফ্যাসাদ ও অশান্তি সৃষ্টি হয়।

নবী করিম (সা.) বলে গেছেনÑ প্রত্যেক জাতির জন্য, প্রত্যেক উম্মতের জন্য ফেতনার একটা বিশেষ জিনিস ছিল। আমার উম্মতের জন্য বিশেষ ফেতনা হলো, সম্পদ। সম্পদের মহব্বত। টাকাপয়সার মহব্বত এ উম্মতের একটা বিশেষ ফেতনা।
হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেনÑ ‘প্রতিটি উম্মতের একটা বিশেষ ফেতনা ছিল। আমার উম্মতের ফেতনা হলো সম্পদ।’ (তিরমিজি : ২২৫৮)।

দরিদ্রতা নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কোনো ভয় ছিল না। দারিদ্র্যের কারণে মানুষের দ্বীনের কোনো ক্ষতি হয় না, অসুবিধা হয় না। কিন্তু দুনিয়ার ধনসম্পদ ও টাকাপয়সার মহব্বত অন্তরে বসে গেলে, হানাহানি-মারামারি শুরু হবে। এজন্য এটা নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) আশঙ্কা করেছেন, ভয় করেছেন।

হাদিসে একটি ঘটনা বর্ণিত আছেÑ বাহরাইন থেকে কিছু সম্পদ মদিনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এলো। সাহাবিরা খবর পেয়ে তা গ্রহণ করার জন্য নবী (সা.) এর কাছে জড়ো হলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের বললেনÑ ‘তোমরা দরিদ্র হয়ে যাবে, গরিব হয়ে যাবে, এ ব্যাপারে আমি কোনো ভয় ও আশঙ্কা করছি না; বরং আমার আশঙ্কা ও ভয় হচ্ছে তোমাদের ব্যাপারে যে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় তোমাদের টাকাপয়সা বৃদ্ধি করে দেবেন। তখন আগের যুগে ইহুদি-খ্রিষ্টানরা যেমন টাকাপয়সা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে ধ্বংস হয়ে গেছে, তোমরাও তাদের মতো টাকাপয়সা নিয়ে ঝগড়া করে ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (বোখারি : ২৯২৪)। দুনিয়ার মহব্বত ও ভালোবাসা ইহুদি-খ্রিষ্টানকে ধ্বংস করেছে। আমাদের যেন ধ্বংস না করে, সেজন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে গেছেন।

এসব হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, পরস্পরে ফ্যাসাদ-অশান্তি-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো দুনিয়ার ধনসম্পদ ও এর মহব্বত। সুতরাং হানাহানি-মারামারি ও ফেতনা-ফ্যাসাদ দূর করার জন্য মানুষের অন্তর থেকে সম্পদের মহব্বত দূর করতে হবে। সম্পদ অর্জন করা যাবে; কিন্তু মহব্বত করা যাবে না। ওলামায়ে কেরাম উদাহরণ দিয়ে বলেছেনÑ বাথরুমের প্রয়োজনে আমরা পকেটে টিসু পেপার রাখি, পকেটে নিয়ে ঘোরাফেরা করি। কিন্তু এর মহব্বত আমাদের অন্তরে থাকে না। ব্যবহার করে ফেলে দিই।
আমরা বাড়িঘর বানাই। বাড়িতে বাথরুম অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা জিনিস। এজন্য কি আমরা বাথরুমকে মহব্বত করি? অপ্রয়োজনে বাথরুমে গিয়ে কেউ বসে থাকি? কাজ শেষ করে দ্রুত সেখান থেকে বের হই।

বোঝা গেল, টিসু পেপার ও বাথরুমের দরকার আছে। কিন্তু এর মহব্বত অন্তরে থাকে না। এভাবে টাকাপয়সার দরকার আছে; কিন্তু এর মহব্বত অন্তরে থাকা চলবে না। যদি মহব্বত ও লোভ অন্তরে না থাকে, তাহলে মাল-সম্পদের দ্বারা কোনো ফ্যাসাদ সৃষ্টি হবে না।

প্রশ্ন হতে পারে, সম্পদের মহব্বত থেকে বাঁচার উপায় কী?
রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি চিকিৎসা বাতলে দিয়েছেন। যে জিনিসের মহব্বত অন্তরে থাকে, সে জিনিস মানুষ পাশে পেতে চায়। ছেলেমেয়ের মহব্বত অন্তরে আছে, তাদের পাশে পেতে চায়। মালের মহব্বত কমানোর জন্য এটাকে বেশি কাছে রাখা যাবে না। বেশি বেশি দান করতে হবে। নিজের কাছে না রেখে দানের মাধ্যমে দূরে রাখতে হবে। তাহলে সম্পদের মহব্বত কমবে। কোনো লোভ থাকবে না। তখন আর কোনো ফ্যাসাদও সৃষ্টি হবে না। মজার ব্যাপার হলো, অন্তর থেকে মহব্বত ও লোভ দূর করার জন্য আপনি দান করবেন। কিন্তু সম্পদ কমবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কথাও বলে দিয়েছেনÑ আল্লাহর রাস্তায় দান করলে সম্পদের মহব্বত ও লোভ কমবে; কিন্তু সম্পদ কমবে না। সম্পদ বাড়তেই থাকবে।

দানসদকা মানুষের মাল কমায় না, বরং বাড়ায়। গণনার গুরুত্ব না দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কথার গুরুত্ব দিন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে দানে টাকা কমে; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আপনাকে অদৃশ্যভাবে বৃদ্ধি করে দেবেন, আপনি বুঝতেই পারবেন না।

একসঙ্গে ব্যবসা করেন। সারা দিন বিক্রি করেছেন ১০ হাজার টাকা। পাশের দোকানে কাস্টমারই নেই। আপনার দোকানে এত কাস্টমার কে পাঠাল? এভাবেই বরকত হয়।
মোটকথা, দানসদকা সম্পদ কমায় না, বাড়ায়। সুতরাং দানসদকার মাধ্যমে সম্পদের মহব্বত ও লোভ দূর করতে হবে। তাহলে ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হবে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button