ঝিনাইদহ সদরটপ লিড

ঝিনাইদহের মামুন হোসাইন : শিল্পের বহুমাত্রিক কারিগর

মামুন হোসাইন। বহুমাত্রিক কাজ, কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা খুব কম সময়ে তাকে পরিচিত করে তুলেছে সূধীমহলে। ইতিপূর্বে মামুন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ একাধিক পুরস্কার পেলেও সম্প্রতি তিনি শিশুতোষ বই অলঙ্করণের জন্য পেয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক শিশু একাডেমি পুরস্কার। এই পুরস্কার মূলত দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্জন। মামুন এটি অর্জন করেছেন খুব দ্রুত। তার কাজ এই পুরস্কার অর্জনের পথে প্রধান সহায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন দেশের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ শিল্পীগণ।

মামুনের  চিত্রকর্মের পেছনের প্রেরণা তার মা। মফস্বল শহর ঝিনাইদহের ব্যাপারীপাড়ায় মামুনের জন্ম। শৈশব-কৈশোরের বড় একটা অংশ কেটেছে গ্রামে। মা ছবি আঁকতেন ভিন্ন আঙ্গিকে। কারণ ছবি এঁকে এঁকে মা নকশি কাঁথা সেলাই করতেন। সে সব ছবিতে ফুটে উঠত গ্রামের সহজ সরল দৃশ্য বা মোটিভ। একসময় আমাদের মা-মাসিরা বিকেলের অলস আলোয় উঠোনে বা ঘরের বারান্দায় বসে নকশি কাঁথা সেলাই করতেন। এই শিল্পের চর্চা তাদের হাত ধরেই টিকে ছিল। ফুল-লতা-পাতা-মাছ-গাছ-নদী-চাষি- সব ফুটে উঠত সুই-সুতায়। এভাবেই মিহি সেলাইয়ে প্রাণ পেত সেই নকশি কাঁথা। বাড়িতে মায়ের এই শিল্পচর্চা দেখতে দেখতে মামুনের ভেতর জন্ম নেয় অঙ্কন স্পৃহা। গড়ে উঠতে থাকে ভীত। মামুন বলেন, ‘আমার শৈশব কৈশোরের বড় একটা অংশ কেটেছে গ্রামে। সবুজ সুন্দর একটা গ্রাম। মায়ের আঁকা নকশি কাঁথার এই সব মোটিভের সাথে ছিলো আমার নিত্য বসবাস। কাছে থেকে মাকে দেখেছি। দেখেছি একজন শিল্পীকেও। মা ছাড়া যেমন জীবন চলে না। ছবি আঁকাও তেমনি আমার রক্তে-স্নায়ুতে মিশে গেছে মা’র কারণে।আমার ছবি আঁকার বীজ তার কাছ থেকেই পাওয়া।’

শৈশব কাটিয়ে স্কুল পর্ব শেষ করে ঝিনাইদহের আলো-বাতাস, কাদা-মাটির সাথে শুরু হয় জীবনের আরেক ধাপ। এরপর চারুকলায় পড়া। নারায়ণগঞ্জ চারুকলায় তার আঁকা বিস্তার লাভ করে। বিভিন্ন মাধ্যমে মামুন আঁকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। মাঝেমধ্যে দেখা যেত তার ছবির ভেতর কাঁথা স্ট্রিচ চলে আসতো। মামুন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে বুঝলাম জীবনে ছবি আঁকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। করতে চাইও নি, এবং সেটাই করছি এখনো।’ মামুনের কাজ বহুমাত্রিক। টাইপোগ্রাফি থেকে কার্টুন, প্রচ্ছদ, স্কেচ, অলঙ্করণ সব ধরনের কাজেই তিনি সিদ্ধহস্ত। কিন্তু মামুনের আগ্রহ চিলড্রেন বুক ইলাস্ট্রেশনে। একদিকে মফস্বলের নৈসর্গিক দৃশ্য, ভূপ্রকৃতিগত অবস্থান, ঋতু বৈচিত্র্যের প্রভাব, মানুষের সারল্য, কোথাও অনগ্রসরতা, গ্রামীণ জীবন উদযাপন, পাখির ডাক, দুপুরে ঘুঘুর বাসা খুঁজে ফেরা, বৃষ্টি ভিজে খেলাধুলা, দলবেঁধে পুকুরে ঝাপাঝাপি, যাত্রা, পূজা, ঈদের আনন্দ উদযাপন- সবই মামুনের জীবনের অনুষঙ্গ।

মামুনের ছবি আঁকার টাইপ মিনিয়েচার। ছোট একটা কাগজে কত ডিটেইলে আঁকা যায়, তার কাজ না দেখলে বোঝা যাবে না। তার একটা ছবির ভেতরে অনেকগুলো গল্প থাকে। সোদা মাটির গন্ধে ভরা মামুনের চিত্রকলা। কাদা মাখা জীবনের ইতিবৃত্ত পাওয়া যায় তার ছবিতে। এ বিষয়ে মামুনের বক্তব্য- মিনিয়েচার মাধ্যমে কাজ করা খুব সহজ। চলতে চলতে বা কথা বলতে বলতে আঁকা সম্ভব। আর এতে তেমন খরচ নেই, আলাদা স্পেসের প্রয়োজন নেই। উপকরণ হিসাবে একটা স্কেচ বুক যা পকেটেও রাখা যায়, আর একটা বলপেন যা সহজলভ্য। তার মানে বিষয়টা দাঁড়ালো এই উপকরণ বা কাজের ঘনঘটা নেই, অথচ তার মধ্যেই অনেক ভালো কাজ করা সম্ভব।

মামুন বহুমাত্রিক কাজের কারিগর। তবে তার মুন্সীয়ানার মূল জায়গাগুলো হচ্ছে রেখা ও টোনের জাদুকরী। তার ল্যাণ্ডস্কেপে ছোটগাছ বা গাছের গায়ের যে চলটা, ঘাসের আধিক্য লতাপাতা, কিছুই বাদ পড়ে না। এত ডিটেইল কাজ কাগজে-কলমে ভাবাই যায় না!

মামুন হোসাইনের পোট্রেইট ড্রইংয়েও বিশেষত্ব রয়েছে। কোনো ক্যানভাসে নয়। কাগজে সেই মিনিয়েচার টাইপ। কিন্তু সেখানে প্রাণ থাকে। মানুষটির ছবি দেখলে তার কর্মপরিধি অন্তর্গত বিষয়টিও ফুটে ওঠে অবয়বে। সম্প্রতি মামুনের আঁকা কয়েকটি পোট্রেইট দেখছিলাম। একটি মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর। জীবন্ত সেই কাজ! বিনয় মজুমদার, হুমায়ূন আহমেদ সবার ব্যাপারে কথা একটাই- পোট্রেইটের ভেতরে তার চরিত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পাখিবিশারদ শ্রদ্ধেয় ইনাম আল হক, নিত্য উপহারের কর্ণধার বাহার রহমানের পোট্রেইটের ক্ষেত্রেও কথা একই। দুজনই বিনয়ী সৃষ্টিশীল মানুষ। ইনাম আল হকের ছবিটা এত জীবন্ত এবং তার মুখে, গলায়, শার্টে বিভিন্ন  পাখির মোটিভ উঠে এসেছে। আধো হাসিরত ইনাম আল হকের স্বভাবসুলভ সেই পরিচিত হাসি। এতসব পাখির চিত্রায়নে মূল পোট্রেইটে কোনো ধাক্কা লাগেনি বরং বাঙময় হয়ে উঠেছে।

মামুনের প্রচ্ছদেও বিশেষত্ব আছে। তবে এক্ষেত্রে মামুনের সরল স্বীকারোক্তি- প্রচ্ছদের কাজ এখনো শিখছি। নিত্য নতুনভাবে দেখছি প্রচ্ছদের আদ্যোপান্ত। আমার প্রচ্ছদ শিল্পের শিল্পগুরু ধ্রুব এষ। প্রতিনিয়তই শিখছি তাঁর কাছ থেকে। আসলে ধ্রুব দা’র এক্সপেরিমেন্টের জগতটা এতটাই বৈচিত্র্যময় যে, আমি সে জগতের প্রেমে পড়ে আছি। আমি আঁকি, তাঁকে দেখাই, প্রশংসা করেন, বিস্মিত হন, আবার ভুল ত্রুটি নিয়েও কথা বলেন। আমি সমৃদ্ধ হই। প্রতিনিয়ত আমি তার কাছে চর্চা করি। আরো কতো নতুন করে প্রচ্ছদ শিল্পকে দাঁড় করানো যায় তার চেষ্টা করি। মেধাবী শিল্পী তো অনেকেই আছেন। কিন্তু ধ্রুব দা’র মত সৃষ্টিশীল শিল্পী দেশে খুব বেশি কি আছেন? শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। প্রিয় শিল্পী, প্রিয় মানুষ। তাঁর কাজে রয়েছে নিজস্ব রং ও ঢং। খুব ভালো লাগে। আরও অনেকের কাজই ভালো লাগে। সব্যসাচী মিস্ত্রী, মেহেদী হক, বিপ্লব চক্রবর্তী, সাদাত, তীর্থ, রোমেল, জোনায়েদসহ অনেকের কাজই মুগ্ধ করে। এই জগতটা তো ক্রমেই বড় হচ্ছে। নিত্য নতুন শিল্পী আসছেন। নতুন কাজ আসছে। নতুন মানুষ আসছে। আইডিয়ার ক্ষেত্র সমৃদ্ধ হচ্ছে।

মামুনের চিলড্রেন ইলাস্ট্রেশন প্রতিনিয়ত ধারা বদলায়। মামুনের বেশি পক্ষপাত সম্ভবত এ কাজটির মধ্যে। মামুনকে তাই প্রশ্ন করি- চিলড্রেন ইলাস্ট্রেশনকে বিস্তৃত করা বা এই ধরনের কোন প্রোগ্রাম হাতে নেয়ার পরিকল্পনা আছে কিনা? মামুন বলেন, ২০১২ সালে ‘টানটোন’  নামে একটা স্কুল শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে থেকে বা বাইরে থেকে যদি কেউ চিলড্রেন ইলাস্ট্রেশন বা মিনিয়েচারের কাজ শুরু করেন তাহলে শেখাতে কার্পণ্য করবো না। কিন্তু আগ্রহ তো অন্য কেউ তৈরি করতে পারে না। তা আমিও পারি না। যে আসবে কাজ শিখতে, তার জন্য আমার দুয়ার খোলা।  পুরস্কারপ্রাপ্তি বিষয়ে মামুন বলেন, এটা আসলে এক ধরনের স্বীকৃতি। যেকোন স্বীকৃতি কাজকে গতিশীল করে। সেটা শুধু পুরস্কার নয়, কারো সঠিক প্রশংসাও এ ক্ষেত্রে মূল্যবান।

ঝিনাইদহের আদর্শপাড়াতে তার পৈত্রিক বাড়ী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button