পাঠকের কথা

বড় বিপর্যয়ে মানুষ অসাধারণ হয়ে ওঠে—এম এ কবীর (সাংবাদিক)

ঝিনাইদহের চোখঃ

বড় বিপর্যয়ে মানুষ অন্যের সাহায্যে অসাধারণ হয়ে ওঠে। এবারেও সেটা দেখতে পাচ্ছি। শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটি মিথ্যা নয়, অনেকেই বিপর্যয়ের সুযোগও নিয়ে থাকেন। ভালো-মন্দ দু‘ রকমের খবরই পাই। আগে একটা সময় ছিল যখন দেশের আনাচে-কানাচে ঘটে যাওয়া অনেক সংবাদ সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছুতো না। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের কারণে আজকাল আর সেটি ঘটে না। দৃষ্টিকটু যেকোন খবর চোখের পলকে সারাদেশে ছড়িয়ে যায়। অন্যায় করে শাস্তি পাওয়ার আগেই এক ধরনের সামাজিক বিচার হয়ে যায়।

এরই মধ্যেই দেশের শিক্ষাবিদ,দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, তাদের পরিবারের সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন।
গত কয়েকদিনে মানুষের মন এবং মনোজগৎ নিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি হয়েছে যদিও কোন কুলকিনারা পাওয়া যায়নি। মূল বিষয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের আক্রান্তের সংবাদগুলো নিয়ে মন্তব্য সম্পর্কিত। অধিকাংশ মন্তব্যকারীই উল্লাস বা উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেছেন! ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তোলার মত।

চিরাচরিত সংস্কৃতিতে এটা যায় না! গ্রামে কোনো বাড়িতে কেউ মারা গেলে ওই বাড়িতে ৭ দিন পর্যন্ত চুলা জ্বলতো না। আশেপাশের বাড়ি থেকে প্রতি বেলায় খাবার যেতো।

ঈদের মত পূজায়ও চলতো নেমন্তন্ন। পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ সম্প্রীতি সব গেল কোথায় ? মানুষ কেন এমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠল ? কেন অন্যের চরম বিপদে এমন নির্লজ্জ আচরণ ?

বয়সী মানুষ যারা এই দেশের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার ভেতরদিয়ে পরিণত, তাদের কিন্তু এই সত্যটি অনেকদিন থেকে জানা। পৃথিবী সুন্দর, দেশটা আরও সুন্দর, জীবনটা তার থেকেও বেশি সুন্দর! একেবারে চরম দুঃসময়ের সময় যখন পরের দিন বেঁচে থাকবো কিনা সেটাও জানতাম না, তখন মনটা কোনও বড় কিছুর জন্য আকুলি-বিকুলি করত না। মনটা আকুলি-বিকুলি করতো খুব ছোট একটা কিছুর জন্য, খোলা রাস্তায় মুক্ত স্বাধীনভাবে হাঁটার জন্য! নতুন প্রজন্ম, তাদের ভেতরেও নিশ্চয়ই কিছু একটা কাজ করে! তারা বড় কিছু চায় না। তারা আবার স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, বন্ধুদের নিয়ে গল্প করবে, চা খাবে টংয়ে বসে ।

দুঃসময়, নতুন প্রজন্মকে জীবনের মূল্যটা হয়তো একটুখানি বুঝিয়েছে। এ দেশের নতুন প্রজন্ম নয়, সারা পৃথিবীর নতুন প্রজন্মকে। সেটারও নিশ্চয়ই মূল্য আছে।

একটু পেছনে ফেরা যাক -আমরা অধিকাংশই নিজের বিষয় নিজে চিন্তা করতে জানি না। নিজের ভালোমন্দ নিরূপণ করতে অক্ষম, অন্যের পরামর্শ এবং শোনা কথায় যাবতীয় কর্মকান্ড চলে। আর নিজের ব্যর্থতার জন্য সব সময়ই দায়ী করার মত কাউকে না কাউকে পেয়ে যাই। নিজের দুর্বলতার দিকে একবারও নজর দিই না।

আমাদের মনের উপর একটা গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। সজ্ঞানে তার বাইরে যেতে পারি না। যে কোন কাজেই আমরা এক পা এগিয়ে আবার তিন পা পিছিয়ে যাই। এক ধরনের মানসিক ভীতিই আমাদের চালিত করে। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে।

নিত্যদিন ঘটে চলা অনিয়মগুলো মানুষের মনে দারুণ প্রভাব ফেলে । মাঝেমধ্যেই তা থেকে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেক কিছু মেনে নিলেও, মনে নেয় না। খাঁচায় বন্দি পাখির আকাশে ওড়ার জন্য যেমন ছটফটানি থাকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শিকারির ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টা থাকে, তেমনি বিক্ষুব্ধ মন বিকৃত হতেও সময় নেয় না।

হরহামেশাই দেখি সামান্য দুই টাকা কম ভাড়া দেয়ার জন্য বাসের যাত্রী তুমুল বাকবিতন্ডা, চিৎকার চেঁচামেচি, গালাগালি এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত চলে। সমস্যা দুই টাকা বেশি-কম নিয়ে নয়। সমস্যা আরও গভীরে। তীব্র গরম , প্রচন্ড জ্যামে অতিষ্ঠ, ঠাসাঠাসি করে বাসে ওঠা মানুষ মনে করে তারা নানাভাবে বঞ্চিত। বৈষম্যের শিকার। ভাবেন, দুই টাকা কম তারা দিতেই পারেন।

নিজেদের অনিরাপদ,অসহায় ভাবতে ভাবতে মনে এক ধরনের ক্ষোভ – হতাশা জমতে থাকে। আশঙ্কার কথা হল ক্ষোভ প্রশমনের জন্য চরম ও চূড়ান্ত অপরাধকেও আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়! বিচার বিবেচনার ধার না ধেরে অন্যায় জেনেও অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে মানুষ।

মানুষের অপরাধপ্রবণ ও অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তিনটি বিষয় কাজ করে-
এক. সামাজিক নিয়ম বা প্রথা
দুই. ধর্মীয় বিধি বা অনুশাসন
তিন. রাষ্ট্র আরোপিত আইন।
এই তিনটি উপাদান পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত। যখন কোনও একটা ঠিকমতো কাজ করে না তখন অন্যগুলোতেও ফাটল ধরে।

যখন আস্থার সংকট দেখা দেয়; অনিশ্চয়তা – গুজব তখন আমাদের গ্রাস করে ফেলে। নিরাপত্তাহীনতার চাদরে কুঁকড়ে মুচড়ে পড়া মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সাময়িক সমাধান নয়, প্রয়োজন ক্ষোভ প্রশমন। সবাইকে আস্থা ফিরিয়ে দেয়া। সংযত ও দায়িত্বশীল আচরণ।

আমাদের মনের আদিম সংস্কারগুলো এখনও কাটেনি। আমরা কিছুই গ্রহণ করি না মনের গভীরে। ভাসা -ভাসাভাবে, অনেক কিছুই জানার ভান করি। আমাদের জানাশোনার পরিধি খুবই সংকুচিত। মনও একেবারে অপরিণত। সবচেয়ে মজার কথা হল, এ কথাটা ভুলে থাকার জন্যই আমরা প্রাণান্তকর চেষ্টা করি। অনেক খবরই হয়তো আমরা জানি কিন্তু কোনও কিছুকে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, প্রজ্ঞা দিয়ে নিজের করতে জানি না।

যখনই কোনও ব্যবস্থার মধ্যে অসঙ্গতি দেখা দেয়, তখন গোঁজামিল দিয়ে শেষরক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। অনেকটা শিশুর মত, অবুঝের মত-হাতের কাছে, চোখের সামনে যা আসে তা নিয়েই এক ধরনের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা। কোন দূরদর্শিতা নেই। তাই যেকোনও অপ্রিয় সত্যকে ঢেকে রাখাতেই সমস্ত প্রয়াস।

মানুষের আবেগ যখন শেষ হয় তখন সে বারুদে পরিণত হয়। বারুদ সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে। এখনও যেকোনও বিপদ বা সংকটে মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এই মাটি অনেক নরম। আবার এই নরম মাটি পোড়ালেই শক্ত ইট হয়। সেই ইট ইমারত তৈরিতে ব্যবহার হতে পারে আবার কারো মাথা ফাটাতেও ব্যবহার হতে পারে। কিভাবে ব্যবহার হবে তার উপরই নির্ভর করে এর কার্যকারিতা। তবে একটাই চাওয়া আবেগী মানুষগুলো যেন বারুদ হয়ে জ্বলে না ওঠে।

বড় চেয়ারে বসলে বিশালত্ব আসে না। মোগলদের শেষ বংশধর বাহাদুর শাহকে আক্ষেপ নিয়ে মরতে হয়েছিল রেঙ্গুনের নির্জনবাসে। নিজের দেশে দাফনের জন্য একখন্ড জমিও মেলেনি।
ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। মিছে অহংকারে লাভ নেই।

ডিএমপির এক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘গুলশানের ফ্ল্যাটে থাকলেও মানুষের মানসিকতা বদল হয়নি।’ ঘটনা এক দারোয়ানকে নিয়ে। ফেরিওয়ালা ঝাড়ু বিক্রি করতে গেলেন গুলশান এলাকায়। ফ্ল্যাটের মেম সাহেব নিচের দারোয়ানকে নিয়ে এলেন ঝাড়ু কিনতে। ফেরিওয়ালা দাম চায় ৬০ টাকা। দাম বেশি বলে মেম সাহেব ব্যথিত হলেন। এই ক্ষোভে ক্ষুব্ধ দারোয়ান থাপ্পড় মারলেন ফেরিওয়ালাকে। ফ্ল্যাট মালকিন ওপরে চলে গেলেন। মার খেয়ে ফেরিওয়ালা কাঁদতে কাঁদতে সামনে হাঁটতে থাকেন। হঠাৎ পুলিশের গাড়ি দেখে নিজের দুঃখের কথা জানান। গাড়িতে ছিলেন এডিসি পর্যায়ের এক কর্মকর্তা। তিনি সব শুনে গুলশানের সেই বাড়িতে গেলেন। ব্যবস্থা নিলেন। সতর্ক করলেন গুলশান গিন্নিকে। তারপর ফেসবুকে লিখলেন- ‘ওদের তুমি গুলশানে রেখেছ মানুষ করনি।’

দরিদ্র মানুষ বিক্ষোভ করছে, সেটি বোঝা যাচ্ছেনা এমন নয়। দ্ব›দ্বটা জীবন এবং জীবিকারও নয় – ‘ বাঁচার চেষ্টা মাত্র।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button