টপ লিডশৈলকুপা

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় দেশীয় অস্ত্রের মজুদ, ক্যাইজার একাল-সেকাল

আব্দুর রহমান মিল্টন, ঝিনাইদহের চোখ:

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ঢাল-সড়কি রামদা সহ দেশীয় অস্ত্রের মজুদ ক্রমেই বেড়ে চলেছে । গ্রামাঞ্চল সহ পাড়ায় মহল্লায় তুচ্ছ ঘটনা কে কেন্দ্র করে শত শত দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সামাজিক একাধিক গ্রুপ হানাহানি ও ক্যাইজাতে লিপ্ত হচ্ছে । রাজনৈতিক দলগুলোও আধিপত্য ধরে রাখতে ব্যবহার করছে দেশীয় এসব অস্ত্র। এ অঞ্চলে বছরের পর বছর হত্যা-খুনের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তার বেশীর ভাগই ঢাল-সড়কি, রামদা-ফালা বা দেশীয় অস্ত্রের মাধ্যমে হয়েছে। আর আহতের সংখ্যা হাজার হাজার ছাড়িয়ে যাবে । হাসপাতালে আগত বেশীর ভাগই রোগীই আসে ক্যাইজা আর সংঘর্ষের ।

সর্বশেষ গত দুদিন আগে পৌরসভার দেবতলা গ্রামে এমনসব অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ২০জনের বেশী আহত হয়। বর্তমানে পুরুষশূণ্য অবস্থা বিরাজ করছে গ্রামটিতে। লুটপাটের অভিযোগও করছে অনেকে। সেই রেশ থামতে না থামতেই আজ রবিবার শৈলকুপা পৌরশহরে দিনভর রামদা, ঢাল-সড়কি সহ নানা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া চালিয়েছে স্থানীয় আওয়ামীলীগের একাধিক গ্রুপ। চলতি উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের মধ্যে কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে হাট-বাজারের মধ্যে প্রকাশ্যে এমন মহড়ার কারণে দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায় । সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও, চোখের পলকে ফাঁকা হয়ে যায় শহর। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশংকা দেখা দেয়ায় শহরে র‌্যাব-পুলিশ টহলে নেমে পরিস্থিতি শান্ত করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শহরের কবিরপুর, চৌরাস্তামোড়, থানামোড়, উপজেলা মোড়, হলমার্কেট সহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয় । শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। এদিকে দুপুরে শৈলকুপার রয়েড়া বাজারে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামীলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে ৮জন আহত হয়, তাদের মধ্যে ৩জনের অবস্থা গুরুত্বর । তাদের কে শৈলকুপা ও ঝিনাইদহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

সামাজিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, জমিজমা নিয়ে বিরোধ বা রাজনৈতিক উত্তেজনায় শৈলকুপা উপজেলার পৌরসভা, মনোহরপুর ইউনিয়ন, হাকিমপুর ইউনিয়ন, উমেদপুর ইউনিয়ন, দুধসর ইউনিয়ন, ত্রিবণী ইউনিয়ন সহ কয়েকটি ইউনিয়নে গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে রয়েছে দেশীয় অস্ত্র । ক্রমেই এসব অস্ত্রের মজুদ আর ব্যবহার বেড়েই চলেছে। বাড়ি-ঘরে নির্দিষ্ট আস্তানা, কখনো বা পুকুর-ডোবাতে এসব অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয় ।
এখানে তুচ্ছ ঘটনায় মানুষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে রয়েছে দেশীয় অস্ত্র ঢাল, তলোয়ার, রামদা, সড়কি ও লাঠিসোঁটার মজুত। ফলে হতাহতের ঘটনা বেড়েই চলেছে।

বহুকাল আগ থেকেই এই অঞ্চলে গ্রাম্য দলাদলি রয়েছে এবং মোড়ল মাতুব্বরগণ এসব দল পরিচালনা করে থাকেন। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এক মাতুব্বরের সাথে অপর মাতুব্বরের শত্রুতা দীর্ঘদিনের। নিজের দল বড় করতে কূট চাল চালেন তারা। গ্রামে সৃষ্টি হয় অশান্তি। এ অশান্তি থেকে দু’দল সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। গ্রাম্য ভাষায় বলে কাইজ্জা। আগে হাটে কাড়া দিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে কাইজা হতো। বিভিন্ন গ্রাম থেকে সরদার ভাড়া করে আনা হতো। হাজার হাজার মানুষ কাইজা দেখতে ভিড় করত। এখন অবশ্য কাড়া দিয়ে বা দিনক্ষণ ঠিক করে কাইজা হয় না। কিন্তু কাইজা বন্ধ হয়নি। প্রায় প্রতি মাসেই উপজেলার কোন না কোন গ্রামে কাইজা হয়। মানুষ হতাহত হয়। সব কাইজার ঘটনায় থানায় মামলা হয় না। পুলিশও বলতে পারে না কতটি কাইজা হয়েছে। ছোটখাট কাইজা পুলিশ আমলে নেয় না।

সময় বদেলেছে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ক্যাইজার সাথে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সম্পৃক্ততা বেড়েছে । বিভিন্ন গ্রাম্য মাতব্বর, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক অনেক নেতার মদদে ঢাল-সড়কি বা দেশীয় সব অস্ত্র-শস্ত্র সরবরাহ করা হয়ে থাকে। অনেক সময় এসব নেতাদের হস্তক্ষেপের কারণে এমনসব দেশীয় অস্ত্র উদ্ধারে সফল হয় না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী । পুলিশের সামনেই কখনো দলবল বেঁধে প্রকাশ্যে এমন অস্ত্রের প্রদর্শন আর মহড়া করতে দেখা যায় । কয়েকমাস আগে শৈলকুপার রামচন্দ্রপুর এলাকায় ঢাল-সড়কি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় পুলিশ দুধসর ইউনিয়নের ভাটই এলাকার কয়েক যুবক কে আটক করেছিল । এনিয়ে ভাটই গ্রামে দু’পক্ষ ক্যাইজাতেও লিপ্ত হয়, বাক-বিতন্ডা আর হানাহানিতে আহত হয়েছিল কয়েকজন। এভাবে চলতে থাকায় শহর ও গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সারাক্ষণ নানা উদ্বেগ-আতঙ্ক বিরাজ করছে ।

দেশীয় অস্ত্রের মজুদের কথা জানিয়ে অবশ্য পুলিশ বলছে দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবহার আগের চেয়ে এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। ইউনিয়নে ইউনিয়নে বিশেষ কাউন্সিলিং চলছে পুলিশের উদ্যোগে, কাজ করে চলছে কমিউনিটি পুলিশের টিমও।

শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আয়ুবুর রহমান জানিয়েছেন, পুলিশের উদ্যোগে ইউনিয়নগুলিতে দেশীয় অস্ত্রের মজুদ উদ্ধারে নানা কার্যক্রম চলছে । যারাই আইনশৃঙ্খলা অবনতির চেষ্টা করবে তাদের গ্রেফতার করা হবে ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button