জানা-অজানাঝিনাইদহ সদরটপ লিডদেখা-অদেখা

ঝিনাইদহের মৌ চাষী জালাল মিয়া, সাফল্যের কারিগর

রাসেল আহাম্মেদ, ঝিনাইদহের চোখঃ

পরিশ্রম চেষ্টা আর লক্ষ মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে পারে।

অনেকটা শখের বশেই বছর পনেরো আগে মৌ চাষ শুরু করেছিলেন। তেমন কারিগরি প্রশিক্ষণ ছিল না,মৌ চাষিদের সাথে কথা আর বইপত্র ঘেঁটে মৌ চাষ ও খাঁটি মধু সংগ্রহের কলা-কৌশল জেনে নিয়েছিলেন তিনি। এরপর জমানো ছয় হাজার ছয়শ’ টাকা দিয়ে কাঠের তৈরি ১১টি মৌ-বাক্স কিনে আনেন এবং পুরোদমে আত্মনিয়োগ করেন মৌ চাষে। বর্তমানে বছরে মধু সংগ্রহ ও বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা আয় করেন তিনি।

মৌ চাষ ও মধু সংগ্রহ করে সংসারের অভাব দূরকারী এই ব্যক্তি হলেন হাজী মোঃজালাল উদ্দিন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ৭ং মহারাজপুর ইউনিয়নের ১ং ওয়ার্ডের পরমানন্দপুর গ্রামের মৃতঃ কিতাব উদ্দিনের কনিষ্ঠ পুত্র । তার মতে, মৌমাছি পালনে একদিকে পরিবারে সচ্ছলতা আসে, অন্যদিকে মৌমাছির বিচরণে পরাগায়নের ফলে ফসলের উৎপাদনও বাড়ে।

জানাযায়, জালাল উদ্দিন কেবল মৌ চাষ করেন না; তিনি বর্তমানে মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য, তিনি আশেপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে মধু সংগ্রহও করেন। এরপর প্রক্রিয়াজাত করে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান।

সরেজমিনে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের ১ং ওয়ার্ডের পরমানন্দপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনার পাশে সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছে মৌ-বাক্স। মৌমাছি সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে এসব বাক্সে জমা করছে। প্রতিটি বাক্সের উপরিভাগ কালো পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। কালো পলিথিনের মোড়ক খুলে মৌ-বাক্স থেকে কাঠের ফ্রেমে ধরে থাকা মৌচাক বের করা হচ্ছে। এরপর মধু আহরণ যন্ত্র দিয়ে চাক থেকে মধু বের করে নেওয়া হচ্ছে।

খামারের কর্মচারীরা জানান, ৭-৮ দিন পর পর মধু সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি মৌ-বাক্সে আছে একটি করে ‘এপিস মেলি ফেরা’ জাতের রানি মৌমাছি। রানির আকর্ষণে ২৫০ থেকে ৩০০টি পুরুষ মৌমাছি মুখে মধু নিয়ে বাক্সে প্রবেশ করে মধু জমা রেখে চলে যায়। রানিদের প্রত্যেকের শরীরের ঘ্রাণ আলাদা রকমের। এক বাক্সের মৌমাছিরা কখনো অন্য বাক্সে যায় না। ভুল করে গেলেও ওই বাক্সের মৌমাছিরা তাকে মেরে ফেলে। আর রানিদের ঘ্রাণ যাতে বাইরে না ছড়ায় সে কারণেই প্রতিটি বাক্স মোটা কালো পলিথিন দিয়ে মোড়ানো হয়। রানি প্রতিদিন একটি করে পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে দৈহিক মিলন ঘটায়। মিলনের পর পুরুষ মৌমাছিটি মারা যায়।

খামারের কর্মচারীরা আরও জানান, দুই ধরনের মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করা যায়। একটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বন্য মধু এবং অপরটি দেশীয় জাতের মৌ চাষ। সাধারণত বন্য মৌমাছিরা গাছের ডালে এবং বনজঙ্গলের চাকে মধু ছাড়ে। অপর দিকে দেশীয় মৌ চাষ হয় কাঠের তৈরি বাক্সের মধ্যে। জালাল উদ্দিন দ্বিতীয় পদ্ধতিতেই মধু সংগ্রহ করেন।

কর্মচারীরা জানান, জালাল উদ্দিনের খামারে বর্তমানে দুই শতাধিক মৌ-বাক্স রয়েছে। প্রতিটি বাক্সের মূল্য ৭-৮ হাজার টাকা। এই খামার থেকে বছরে প্রায় ১০ টন এর বেশি মধু উৎপাদন করা সম্ভব হয়।

জালাল উদ্দিন জানান, ২০০৪ সালে মাত্র ১১টি মৌ-বাক্স কিনে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহ শুরু করেন । তারপর থেকেই মৌ চাষেই মনোনিবেশ করেন তিনি। বর্তমানে তার খামারে ৬ জন কর্মচারী রয়েছেন, যারা বছরে ৬মাস মধু সংগ্রহ করেন।

জালাল উদ্দিন আরও জানান, ২০১৫-১৬ সালে ৯ টন ও ২০১৭-২০১৮ বছরে প্রায় ১১ টন মধু সংগ্রহ করেছেন তিনি। এ বছর ১৫ থেকে ২০ টন পরিমাণ মধু পাওয়ার আশা করছেন।

তিনি জানান, বিত্তিপাড়া ও ধুবাইল নাটোরের গুরুদাসপুর, চলনবিল, ঈস্বরদি আলতা পারা, সিরাজগঞ্জ, উল্লাপাড়া, দিনাজপুর, শরীয়তপুর, দারীপুর,মানিকগঞ্জ, সুন্দরবন সহ বিভিন্ন স্থান থেকে মধু সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে সরিষা ফুলের মধু ছাড়া তিনি লিচু ফুলের মধু ও কালজিরা ফুলের মধু সংগ্রহ করেন।

জালাল উদ্দিন বলেন, ‘গত বছর ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে মধু বিক্রি করেছি। গাছি সংগ্রহকারীরা মৌচাকে চাপ দিয়ে মধু সংগ্রহ করেন। এতে মধুর গুণাগুণ ৪০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। আর আমার খামারে যন্ত্রের সাহায্যে বাতাস দিয়ে মধু সংগ্রহ করা হয়। এতে আমাদের মধুর গুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকে।
’সরকারিভাবে মধু বিক্রির ব্যবস্থা করা হলে খামারিরা আরও বেশি লাভবান হবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অল্প সুদে ঋণ দেওয়া হলে এবং সরকারিভাবে মৌমাছি রাখার বাক্স দেওয়া হলে আমরা আরও বেশি উপকৃত হবো।’

মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ খুরশিদ আলম জানান, হাজী মোঃ জালাল উদ্দিন মৌ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তার সাফল্য দেখে আরও অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে মৌ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button