কালীগঞ্জজানা-অজানাটপ লিড

দৃষ্টান্ত:-ঝিনাইদহে প্রতিবন্ধি দুই ভাইয়ের পাশে বোন শিখা

সাবজাল হোসেন, ঝিনাইদহের চোখঃ

শারীরিক প্রতিবন্ধি দুই ভাই হারান আর মনোজিতের একমাত্র বোন শিখা।

বাবা জয়দেব মন্ডল মারা গেছেন প্রায় ২২ বছর আগে। আর বৃদ্ধা মা সুন্দরী মন্ডলের রোগে বাসা বাধা দেহ। ফলে প্রতিবন্ধি ভাইদের দেখার আর কেউ নেই। তাদের কথা চিন্তা করে শিখা ছেড়েছেন শশুরবাড়ি। এখন বাবার ভিটেই ঝুপড়ি ঘর বেধে স্বামী -সন্তান সামলিয়েও অসহায় ভাইদের ঘিরে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। কেননা তিনি সংসারের সামলিয়েও সারাজীবন ছাগল পালন করে প্রতিবন্ধি ভাইদের ভরন পোষনের জন্য অবিরাম কষ্ট করছেন। আর প্রতিবন্ধি দুই ভাই কর্মক্ষমহীন অন্ধ্যকার জীবনে বোন শিখার ’আলোর শিখায়” জগতের পথ পাড়ি দিচ্ছেন। তাদের বাড়ি ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বলরামপুর গ্রামে।

সরেজমিনে শিখার বাড়িতে গেলে দেখা যায়, মাটির উপর টিনের বেড়া আর ছাউনির ঝুপড়ি ঘরে বসবাস শিখার। পাশেই রয়েছে প্রতিবন্ধি ভাইদের সরকারী আবাসনের ঘর। এরই সামনে শিখার ছাগলের ঘর। এ ঘরেই পালন করা ছাগল দিয়ে চালিয়ে থাকেন তার সংসার।

শিখা মন্ডল জানান, অন্য মেয়েদের মত তিনিও শশুর বাড়িতে স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। বাবার মৃত্যুর পর প্রতিবন্ধি দুটি ভাই আর বৃদ্ধা মাকে দেখার কেউ না থাকায় রক্তের টানে বাবার ভিটেই চলে আসেন। তিনি জানান, বড় ভাই হারান মন্ডলের হাত দুটিই ও এক পা সরু। যে কারনে তার কোন কর্মক্ষমতা নেই। আর ছোট ভাই মনোজিতের ছোটবেলা থেকেই এক পা অচল। সেও কোন কাজ করতে পারে না। ক্রাসে ভর করে তাকে পথ চলতে হয়। মা সুন্দরী মন্ডলের বর্তমান বয়স ৮২ বছর। শারীরিক অসুস্থতা আর বয়সের ভারে তিনিও চলতে পারেন না। এমন অবস্থার সংসার তাদের। তিনি বলেন, বসত ভিটের অল্প কিছু জায়গা ছাড়া মাঠে তাদের কোন চাষযোগ্য জমি নেই। ফলে সংসারের অভাব নিত্যসঙ্গী। শিখা আরও জানান, তার স্বামী মনি কুমার কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। একমাত্র মেয়ে রিপাকে বিয়ে দিয়েছেন। স্বামীর সব সময় কাজ থাকে না। তিনি যা রোজগার করেন তা দিয়ে ঠিকমত নিজের সংসারই চলে না। এরপরও মা আর প্রতিবন্ধি দুই ভাইয়ের খাবারসহ সকল দিক সামলানো লাগে।

শিখা আরও জানান, ৩ ভাই বোনের মধ্যে হারান বড় মেজো শিখা আর সবার ছোট মনোজিৎ। নিজের রক্তের ভাই দুটিই অসহায়। তাদের মুখের দিকে তাকালে অত্যন্ত খারাপ লাগে। তাদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে নিজেকে আয়ের পথ বের করতে হয়েছে। অনেক আগে থেকেই বাড়িতে ছাগল পালন করেন। সংসারের কাজ শেষ করে মাঠে মাঠে ছাগল চরিয়ে বেড়ান। বর্তমানে ১৮ টি ছাগল রয়েছে। কিছুদিন পর পর ১ টি করে ছাগল বিক্রি করে সংসারের কাজে লাগান। আবার ছোটগুলো পালন করতে থাকেন। এভাবে চলছে কমপক্ষে ১৩ বছর। তার দাবি স্বল্প সুদে ঋন পেলে আরও বেশি ছাগল পালনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধি ভাই ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে একটু ভালোভাবে চলতে পারতেন।

ছোট ভাই মনোজিৎ মন্ডল জানান, তাদের অনেক কষ্টের জীবন। প্রতিবন্ধি দু’ভাই আর বৃদ্ধা মায়ের আপন বলতে একমাত্র বোনটাই আছে। তাদের অসহায়ত্বের কারনে এলাকার মানুষসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদেরকে ভালো জানেন। ইতোমধে দুই ভাইকে প্রতিবন্ধি ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। কিন্ত ভাতাবাবদ যা পান তা দিয়ে ঔষধ কিনতেই শেষ হয়ে যায়। তাদের খাবারসহ সকল ব্যয়ের জন্য বোন শিখাকে বাড়তি কষ্ট করতে হয়। তাদের জন্য বোন শিখা এতো কষ্ট করে কিন্ত কোন সময় অবহেলা বা বিরক্তি দেখায় না। সে সব সময়ে মায়ের মত করে আগলিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

প্রতিবেশী সালাউদ্দীন আহম্মেদ জানান, প্রতিবন্ধি দু’ভাই হারান আর মনোজিৎ খুব কষ্ট করে। বোন শিখাকে বিয়ে দেয়ার কিছুদিন পরেই তাদের বাবা মারা যায়। এরপর তাদের দেখাশুনার জন্য তেমন কেউ ছিল না। সে সময়ে তাদেরকে অনাহারে অর্ধাহারে থেকে দিন কাটতো। ভাইদের কথা চিন্তা করে বোন শিখা মন্ডল ভাইদের টানে চলে এসেছে বাবার ভিটেই। তাদের ভরন পোষনের কথা চিন্তা করেই শিখা মন্ডল ছাগল পালনসহ অবিরাম জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, প্রতিবন্ধি দুই ভায়ের জন্য বোন হয়ে শিখা যা করে তা এক বোনের ভাইদের প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

নিয়ামতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাজু আহম্মেদ রনি লস্কর জানান, প্রতিবন্ধি দুই ভাই হারান ও মনোজিৎ মন্ডলের অসহায় জীবন যাপন অত্যন্ত কষ্টকর। এলাকার মানুষও তাদের খুব ভালোবাসে। তাদের জন্য ইতোমধ্যে একটি সরকারী ঘর ও প্রতিবন্ধি কার্ড করে দেয়া হয়েছে। তারপরও অসহায় ভাই দুটির জন্য বোন হয়ে শিখা যে কষ্ট করেন সে জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button