কালীগঞ্জ

ঝিনাইদহে অসহায় দুই শিশুর অনিশ্চিত জীবন

সাবজাল হোসেন, ঝিনাইদহের চোখঃ

পৃথিবীতে আমাদের দেখাশোনা করার মতো একমাত্র নানিই আছে। সেও যদি ছেড়ে চলে যায় তাহলে আমরা কার কাছে থাকব এই বিলাপ করছে আর অঝোরে কাঁদছে শিশু মৃত্তিকা (১০)। বড় বোনের কান্না আর নানির সারা শরীরের রক্ত দেখে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে গড়াগড়ি দিচ্ছে ছোট বোন তন্নিও। শিশু দুটির ধারণা পৃথিবীতে তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল নানি, সেও ছেড়ে চলে গেলো। ফলে তাদের আহাজারিতে হাসপাতালের বাতাস হয়েছে ভারি। এমন হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা শনিবার ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ হাসপাতালে। বড় বোন মৃত্তিকার কিছুটা বোঝার বয়স হলেও ছোট বোন তন্নি কিছুই বোঝে না। তারপরও দুই বোনের এই বিলাপ। নানি ফেরদৌসি বেগম (৫০) ইঞ্জিনচালিত লাটা উল্টে জখমে চেতনা হারিয়ে হাসপাতালে আসলে এমন ঘটনা ঘটে। তাদের বাড়ি উপজেলার দামোদরপুর গ্রামে। মাথায় প্রচন্ড আঘাত নিয়ে তিনি এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

শিশু মৃত্তিকা জানায়, তাদের মা বাবা থেকেও নেই। তারা কোথায় থাকে জানি না। ছোটবেলা থেকে নানিই আমাদের সন্তানের মতো করে লালন পালন করছে। ফলে তার কিছু হয়ে গেলে আমরা কোথায় যাব।

আহত ফেরদৌসি বেগম জানান, অনেক দিন আগেই স্বামী শমসের আলী মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে আবিরনকে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্ত দুটি শিশু বাচ্চা মৃত্তিকা আর তন্নিকে ফেলে জামাই মেয়ে দুজনেই কোথায় চলে গেছে। তারা কোন খোঁজ খবরও নেয় না। বসতভিটের অল্প কিছু জমির ওপর একটি ঝুপড়ি ঘরই তাদের ৩টি প্রাণীর একমাত্র সম্বল। অসুস্থতা আর বয়সের কারণে তিনি কোন কাজ করতে পারে না। ফলে অপরের কাছে হাত পেতে তাদের বাঁচতে হয়। এখন অসুস্থ হওয়ায় শিশু দুটির কষ্ট আরও বেড়ে গেছে।

হাসপাতালে ভর্তি ফেরদৌসির পাশের বেডের এক রোগীর সঙ্গে আসা শান্তা খাতুন জানান, মহিলা মাথায় খুব আঘাত পেয়েছেন। তার মাথায় অনেকগুলো সেলাই দেয়া হয়েছে। আপন কেউ না থাকায় শিশু দুটিও তার নানির সঙ্গে একই বেডে থাকছে ঘুমাচ্ছে। নানির ভাত ৩ জনে ভাগ করে খাচ্ছে। এমন অসহায়ত্ব দেখে হাসপাতালের অনেকে তাদের খাবার থেকে খাবার দিয়ে সাহায্য করছেন। তিনি বলেন শিশু দুটির কষ্ট দেখে একজন মানুষ হিসেবে কষ্ট লাগাটা স্বাভাবিক।

উপজেলার ফরাসপুর গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম জানান, উল্টে যাওয়া লাটা গাড়িতে তিনিও ছিলেন। চালক ঘুমাতে ঘুমাতে গাড়ি চালাচ্ছিল। এক পর্যায়ে কালীগঞ্জ-গাজিরবাজার সড়কের ফয়লা মাদ্রাসার কছে আসলে লাটাটি উল্টে যায়। এ সময় গাড়ির ৬/৭ জন যাত্রী আহত হয়েছিলেন। কিন্ত মহিলা ফেরদৌসি বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এ মহিলার সঙ্গে তিনিও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, মহিলার সঙ্গে দুটি শিশু ছিল। তাদের তেমন একটা আঘাত না লাগলেও মহিলার মাথা দিয়ে রক্ত ঝরা দেখে শিশু দুটি অঝোরে কাঁদছিল।

দামোদরপুর গ্রামের ইউপি সদস্য জাফর ইকবাল জানান, ফেরদৌসির বাড়ি তাদের গ্রামে। অত্যন্ত গরিব অসহায় একজন মানুষ। তাদের গ্রামে একটি ঝুপড়ি ঘর বেঁধে তিনি ২ শিশু নাতনি নিয়ে হাত পেতে বেঁচে আছেন। গ্রামের মানুষ তাদের অসহায়ত্ব দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, এরপর আবার দুর্ঘটনায় পড়েছে ফলে শিশু দুটির কষ্ট আরও বেড়ে গেলো।

কালীগঞ্জ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার সুলতান আহম্মেদ জানান, মহিলা মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। বেশ কয়েকটি সেলাই দেয়া হয়েছে। তবে তিনি এখন আশঙ্কামুক্ত। তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে তার যাবতীয় চিকিৎসাপত্র দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ফেরদৌসির আপন কেউ না থাকায় তার সঙ্গে দুটি শিশুও হাসপাতালে থাকছেন। চিকিৎসক সুলতান আহম্মদ আরও জানান, তিনি শুনেছেন শিশু দুটি তার নাতনি। পৃথিবীতে এখন তাদের দেখাশোনা করার জন্য নানি ছাড়া আর কেউ নেই। এমন অবস্থায় তাদের অবলম্বন নানি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button