প্রবাসে ঝিনাইদহ

মালয়েশীয় অভিবাসন নীতির জটিলতায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশিরাই

#ঝিনাইদহের চোখঃ

অবৈধ অভিবাসীদের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমেই বদলাচ্ছে মালয়েশিয়ার অভিবাসন নীতি। দেশটির ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়াটাও জটিল। মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইনের এ জটিলতার কারণে সবচেয়ে বিপাকে রয়েছে হাজার হাজার অবৈধ বাংলাদেশি।

মালয়েশিয়া সরকার এসডিজি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে ডিসেন্ট ওয়ার্ক কান্ট্রি প্রোগ্রাম ২০১৯-২০২৫ গ্রহণ করেছে। জেনেভায় অনুষ্ঠিত আইএলওর কনভেনশনে মালয়েশিয়া সরকার, শ্রমিক ও নিয়োগকর্তার সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) যৌথভাবে ২০২৫ সালের মধ্যে ডিসেন্ট ওয়ার্ক কান্ট্রি প্রোগ্রাম (ডিডব্লিউসিপি) বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে।

গত ১৯ জুন আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনের শতাব্দীর অধিবেশনে জেনেভায় জাতিসংঘে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারকে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারান, মালয়েশিয়ান ট্রেড ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেল সলমান, মালয়েশিয়ান এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এ রামাদাস এবং আইএলওর এশিয়া অ্যান্ড দি প্যাসিফিক রিজিওনের আঞ্চলিক পরিচালক মিজ তমকা নিশিমটো স্বাক্ষর করেন।

ডিসেন্ট ওয়ার্ক কান্ট্রি প্রোগ্রাম (ডিডাব্লিউসিপি) মালয়েশিয়া ও আইএলওর মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদী সহযোগিতা কাঠামো প্রদান করবে। এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে মালয়েশিয়ায় আইএলওর কর্ম সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করবে। মালয়েশিয়ার ডিডাব্লিউসিপি কাজের তিনটি সমন্বিত ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো: কর্মক্ষেত্রে অধিকার: অধিকারের সুরক্ষা প্রদান এবং অধিকার বিষয়ে প্রচার করা।

কাজের ভবিষ্যৎ : বর্তমান ও ভবিষ্যতের কাজের চাহিদা মেটানোর জন্য জাতীয় ক্ষমতা শক্তিশালীকরণ।

ডব্লিউসিপি বাস্তবায়নে ত্রিপক্ষীয় (আইএলও, সরকার এবং মালিক ও শ্রমিক সংগঠন) প্রচেষ্টার জন্য প্রশংসা করে মিসেস টমোকো নিশিমোটো বলেন, ‘আমরা মালয়েশিয়াকে ডিসেন্ট ওয়ার্ক প্রোগ্রামের মাধ্যমে শ্রম অবস্থার শক্তিশালী উন্নয়নে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারান আইএলওর সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এর ফলে ডিসেন্ট ওয়ার্ক বা শালীন কর্মক্ষেত্র বাস্তবায়নে মালয়েশিয়ার সরকার ও সামাজিক অংশীদারদের সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে। এ কর্মসূচিকে স্বাধীনতা, ইক্যুইটি, নিরাপত্তা ও মানব মর্যাদার আলোকে মালয়েশিয়ার উন্নয়ন নীতির কেন্দ্রস্থলে রাখা হয়েছে।

এমটিইউসির মহাসচিব সলোমন বলেন, এমটিইউসি মালয়েশিয়া সরকারের এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে শক্তিশালী সহযোগিতা দিয়ে যাবে। আমরা আশাবাদী ডিডাব্লিউসিপি সুসংগত শিল্প সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং বিকাশের আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে মালয়েশিয়ার শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা ও উন্নয়ন ঘটাবে।

এমইএফ ভাইস প্রেসিডেন্ট এ রামাদাস বলেন, এমইএফ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে সমষ্টিগতভাবে এবং একত্রে কাজ করে নিয়োগকর্তারা সবার জন্য উপযুক্ত এবং উৎপাদনশীল কর্ম নিশ্চিত করবে।

এদিকে মাঝে মধ্যে দেশটির সরকার অবৈধ অভিবাসীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দিয়ে থাকে, কিন্তু বাংলাদেশি দালাল চক্রের কারণে সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি শ্রমিকরা।

প্রবাসী শ্রমিকদের অভিযোগ, পুরো মালয়েশিয়ায় লাখ লাখ অবৈধ বাংলাদেশি বৈধ না হওয়ার পেছনে অসাধু প্রবাসী দালাল যেমন দায়ী। তেমনি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও দায় এড়াতে পারে না।

কুয়ালালাপমপুরসহ মালয়েশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালে অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বৈধ হওয়ার জন্য ‘মাই ইজি,ভূক্তিমেগা ও বিএম’ এ তিনটি ভেন্ডরের মাধ্যমে প্রকল্প চালু করে দেশটির তৎকালীন সরকার।

কিন্তু মালয়েশিয়ার আইন অনুযায়ী, কোনো বিদেশি নাগরিক সরাসরি ইমিগ্রেশনে ভিসা নবায়নের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। অভিবাসন নীতিতে স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমেই (মালয়েশিয়ান নাগরিক) ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়।

ফলে মালয়েশীয় এজেন্টরা আবার অবৈধ বিদেশি সংগ্রহ করতে সাব-এজেন্ট নিয়োগ করে (কারণ তাদের পক্ষে লাখ লাখ অবৈধ বিদেশিদের চেনা অসম্ভব) যাদের মাধ্যমে অবৈধ বিদেশি নাগরিক সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশি প্রবাসীরা বলছেন, পুরো মালয়েশিয়াজুড়ে শক্তিশালী বাঙালি দালাল চক্র রয়েছে। পুরো দেশজুড়ে কয়েক লাখ অবৈধ প্রবাসীদের বৈধ করার জন্য মালয়েশীয় মুদ্রায় কয়েক অর্ধ কোটিরও বেশি রিঙ্গিত হাতিয়ে নেয়। পরে তারা সাইনবোর্ড সরিয়ে উধাও হয়ে যায়। বৈধ করার জন্য প্রতি বাংলাদেশি এজেন্টরা তাদের কাছ থেকে ৫-৮ হাজার রিঙ্গিত হাতিয়ে নেয়। যদিও কৃষি, নির্মাণ ও ফ্যাক্টরিসহ খাত ভেদে সরকারি ফি অনুযায়ী, দেড় থেকে ২ থেকে হাজার রিঙ্গিত লাগার কথা। কিন্তু টাকা দিয়েও প্রতারণার শিকার হয়ে অবৈধই থেকে গেলেন হাজার প্রবাসী।

এ অবৈধ অভিবাসীরা চলমান অভিযানের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের একটাই কথা, বর্তমানে থাকার চেয়ে দেশে ফেরত যাওয়াই ভাল। কিন্তু যাবেন কি করে। সহসা দেশে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ। বিভিন্ন ফোরামে অবৈধদের বিষয়ে দূতাবাসের সংশ্লিষ্টরা আলোচনা করলেও আশ্বাস ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা।

জানা যায়, ২০১৬ সালে ওই প্রকল্প চলাকালে ইমিগ্রেশন কাড (আই) মতো গুরুত্বপূর্ণ নথি কপি করে জাল আই কার্ড তৈরির মতো গুরুতর অপরাধ করে বাংলাদেশিদের একটি দালাল চক্র। একপর্যায়ে নজরে এলে বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে মালয় পুলিশ। কেউ কেউ ধরা পড়ছে আবার কেউ কেউ অধরাই থেকে যাচ্ছে।

প্রবাসীরা বলছেন, দেশটির পুলিশ এখনও এ বিষয়ে কাজ করছে। তবে বিভিন্ন সময় কয়েকটি চক্র ধরাও পড়েছে।

রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দূরের পেরাকে কাজ করেন মো. কলিম উদ্দিন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানালেন, বাংলাদেশ থেকে চার লাখ টাকা দিয়ে অবৈধভাবে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। দালালরা তাকে বৈধ করে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু উল্টো তার কাছ থেকে আই কার্ড করিয়ে দেওয়ার নাম করে সাড়ে ৪ হাজার রিঙ্গিত নিয়ে উধাও হয়ে গেছে আজিজ নামের এক দালাল। তার মতে গত বৈধতার প্রোগ্রামে সবচাইতে বেশি প্রতারিত হয়েছেন বৃহওর সিলেট বিভাগের প্রবাসীরা।

মাগুরার প্রবাসী সাইদুর রহমান জানান, বৈধ হওয়ার জন্য তিনি আবেদন করেছেন, প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও ভিসা হাতে পাননি। তবে মালয়েশীয় এজেন্টের মাধ্যমে আবেদন করার কারণে তিনি প্রতারণার শিকার হননি বলে জানান এই প্রবাসী।

প্রবাসী বাংলাদেশি কোতারায়া মার্কেটের আরেক ব্যবসায়ী কাজী সালাহ উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশিরা নিজেরাই নিজের কপালে কুড়াল মারছে। এখানে যত অনিয়ম, সবই বাঙালিদের দিয়ে হচ্ছে।

বাঙালিরা কোনো আইন মানে না। সব ধরনের অপকর্মই তাদের দ্বারা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত, যারা বিদেশে আসবে তাদের ন্যূনতম প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো।

এছাড়া কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করার পাশাপাশি যারা নানা ধরনের অপরাধে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান এই প্রবাসী বাংলাদেশি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button