নির্বাচন ও রাজনীতি

নির্বাচনে ঝিনাইদহ-সহ ২৪ জেলায় বাড়ছে কেন্দ্রভিত্তিক নিরাপত্তা

জাতীয় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশের পক্ষে ব্যাপক কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। যে কোনো জাতীয় নির্বাচনের আগে রুটিন কাজের অংশ হিসেবে সার্বিক নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এবারের নির্বাচনের আগে-পরের পরিবেশ নির্বিঘ্ন করতে অধিকমাত্রায় কৌশলী হতে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব ইউনিট। এবার ভোট কেন্দ্রভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হচ্ছে।

প্রতিটি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন মাঠপর্যায়ের নেতৃত্বে থাকা উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, সার্বিক পরিস্থিতি, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ, মাঠের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে না দিয়ে তা বিবেচনায় রেখেই প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে আগের চেয়ে নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।

এ বিষয়ে আগেই পুলিশের উচ্চপর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে এবার কেন্দ্রে কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে। মঙ্গলবার পুলিশ সদর দফতরে সব মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও রেঞ্জ ডিআইজিদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এ সভায় নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। পুলিশপ্রধান (আইজিপি) সবার বক্তব্য শোনেন এবং দিকনির্দেশনা দেন। সভায় আগামী নির্বাচন উপলক্ষে পুলিশের কর্মপরিকল্পনা ও কৌশলসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

জানা যায়, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এ আলোচনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায় জাতীয় নির্বাচন। বৈঠকে উপস্থিত থাকতে আগের দিনেই মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এবং রেঞ্জ ডিআইজিরা ঢাকায় আসেন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক ও খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহাম্মদ বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

সভায় উপস্থিত দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোর ও বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার রোধেও নির্দেশনা দেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।

নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলার অবনতি কিংবা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র রুখতেও দেন বিশেষ নির্দেশনা ও কৌশল। সবাইকে চোখ-কান খোলা রেখে সতর্ক থাকতে বলেন। আলোচনায় স্থান পেয়েছে সামাজিক মাধ্যমের বিষয়টিও।

সোশ্যাল মিডিয়া তথা ফেসবুক, টুইটার ও ব্লগে ভুয়া তথ্য দিয়ে গুজব ছড়ানো হতে পারে। কেউ যেন অপপ্রচার চালিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে না পারে, সে ব্যাপারে তৎপর ও সজাগ থাকতে বলা হয়। সামাজিক মাধ্যমে সাইবার টহলের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে সভায়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, বৈঠকে মাঠপর্যায়ের সব তথ্য পর্যালোচনা করা হয়। কোন মেট্রোপলিটন ও বিভাগে কতটি ভোট কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ, কতজন পুলিশ সদস্য লাগবে, পুলিশের চাহিদা, রাজনৈতিক ক্যাডার ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোপনে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি থাকলে সে বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, জামায়াত-শিবির ও সরকারবিরোধী চক্রের তৎপরতা সম্পর্কে বৈঠকে গুরুত্ব পেয়েছে।

পাশাপাশি বৈঠকে নাশকতাপ্রবণ বা স্পর্শকাতর জেলা আলোচনা হলে সেখানে কী ধরণের কৌশলী পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে পুলিশ প্রধান দিকনির্দেশনা দেন।

এ বৈঠকে আগের সংসদ নির্বাচনের সময় দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ২৫টি জেলার বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আজকের আলোচনায় স্থান উঠে আসে। পূর্বের ঘটনা, পরিস্থিতি ও অভীজ্ঞাতা তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট এলাকার উর্ধ্বতন কর্মকর্তরা।

মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও ডিআইজি মর্যাদার কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা সার্বিক বিষয়ে বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন; যা আজকের আলোচনায় স্থান পায়।

এতে গতবারের স্পর্শকাতর জেলাগুলোর তথ্য তুলে ধরেন কর্মকর্তারা। নাশকতাপ্রবণ জেলাগুলো হল- রাজশাহী, বগুড়া, মুন্সীগঞ্জ, শেরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, যশোর, মেহেরপুর, খুলনা, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নীলফামারী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, গাইবান্ধা, হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার। এসব জেলায় আগের সংসদ নির্বাচনে নাশকতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঘটেছিল।

পুলিশ সদর দফতরের এক ডিআইজি যুগান্তরকে বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে কী ধরনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে- এ সংক্রান্ত একটি প্রয়োজনীয় বার্তা দেয়া হয় কমিশনার ও ডিআইজিদের।

কর্মকর্তারা বৈঠকের বার্তা পৌঁছে দেবেন মেট্রোপলিটন ও নিজ নিজ বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে। এছাড়া তফসিল ঘোষণার আগে থেকে নির্বাচনী মাঠের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে পুলিশ যেভাবে কাজ করছে, এক্ষেত্রে কী কী সমস্যা দেখা দিচ্ছে- এসব বিষয়ও আলোচনার মধ্যে ছিল।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এবার এ অঞ্চলে আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্য মোতায়েনে সুপারিশের বিষয়টি পুলিশ সদরে জানানোর জন্য তারা একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরী করেন।

এ সংক্রান্ত একটি প্রাথমিক খসড়া উর্ধ্বতন কর্মকর্তা পুলিশ সদর দফতরে নিয়েও গেছেন। এ পরিকল্পনায় রয়েছে পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায় হেলিকপ্টার টহলের বিষয়টিও।

জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সারা দেশ থেকে একটি ঝুঁকিপূর্ণ আসনের তালিকা তৈরি করেছে। নির্বাচনে সরকারবিরোধী প্রার্থীর লোকজন পেশীশক্তি ব্যবহার করতে পারে। সেই সঙ্গে আছে জামায়াত-শিবিরের লোকজনের নাশকতার আশঙ্কা।

সকল মেট্রোপলিটন ও বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের নিজ নিজ এলাকার ঝুঁকি সম্পর্কে বৈঠকে তথ্য দেন। সে অনুযায়ী যে ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তাও জানান।

আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টসূত্র জানায়, এবারে প্রতি সাধারণ ভোট কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ২ থেকে ৩ জন করে বাড়ানো হচ্ছে। সাধারণ ভোট কেন্দ্রে ১ জন, ঝুঁকিপূর্ন কেন্দ্রে ২ জন করে সদস্য বাড়ানো হতে পারে।

সে হিসেবে মহানগর এলাকায় সাধারণ কেন্দ্রে ১৭, ঝুঁকিপূর্ন কেন্দ্রে ২০ এবং মহানগরের বাইরে সাধারণ কেন্দ্রে ১৫ ও ঝুঁকিপূর্ন কেন্দ্রে ১৬ জন করে নিয়োগ করা হতে পারে। জানা যায়, গতবারের নির্বাচনে বিভিন্ন বাহিনীর সাড়ে চার লাখ সদস্য নির্বাচনী নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল।

আর প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে পুলিশ, আনসার ও গ্রাম পুলিশ কাজ করে। মহানগর এলাকায় প্রতিটি কেন্দ্রে তিন পুলিশসহ ১৬ ও ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে এমন কেন্দ্রে পাঁচ পুলিশসহ ১৮ সদস্য দায়িত্ব পালন করে।

মহানগর এলাকার বাইরে সাধারণ ভোটকেন্দ্রে একজন পুলিশসহ ১৪ ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে দুজন পুলিশসহ ১৪ জন দায়িত্ব পালন করে। তবে এবারের নির্বাচনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংখ্যা আরও বাড়ছে।

সৈয়দ আতিক, যুগান্তর

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button